২০১১ সালের ১১ জুন। অপরাধমূলক ঘটনার তথ্য অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত মুম্বইয়ের খ্যাতনামী সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দেকে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে খুন করা হয়। এই খুনের ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন মুম্বইয়ের ডন ছোটা রাজন।
শুধুমাত্র ছোটা রাজন নন, তাঁর সঙ্গে অভিযুক্তদের তালিকায় জুড়ে যায় জিগনা ভোরার নামও। জিগনার পেশাও ছিল অপরাধমূলক ঘটনার তথ্য অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকতা।
প্রাথমিক তদন্তের পর জ্যোতির্ময়কে খুনের অভিযোগে জিগনাকে গ্রেফতার করে মুম্বই পুলিশ। ছোটা রাজনের দাবি ছিল, জ্যোতির্ময় খুনে মূল অভিযুক্ত তিনি হলেও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন জিগনা।
সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে জ্যোতির্ময় দেকে খুন এবং তৎপরবর্তী ঘটনার উপর ভিত্তি করে ‘স্কুপ’ নামে একটি ওয়েব সিরিজ় মুক্তি পেয়েছে। এই সিরিজ়টি জিগনা ভোরার লেখা বই ‘বিহাইন্ড বার্স ইন বাইকুল্লা: মাই ডে’জ় ইন প্রিজ়ন’-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি।
হনসল মেহতা পরিচালিত ‘স্কুপ’ ওয়েব সিরিজ়ে জিগনা ভোরার চরিত্রটির নাম জাগ্রুতি পাঠক। জাগ্রুতির চরিত্রে অভিনয় করেছেন করিশ্মা তন্না। এই চরিত্রের উত্থানপতন সুনিপুণ ভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন করিশ্মা। সিরিজ়ে জাগ্রুতিকে দেখার পর জিগনা ভোরার জীবন নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে দর্শকের।
মুম্বইয়ের একটি নামকরা সংবাদপত্রে অপরাধমূলক ঘটনার অন্তর্তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক ছিলেন জিগনা। মুম্বইয়ের একটি কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। ডিপ্লোমা কোর্স চলাকালীন অপরাধমূলক ঘটনার অন্তর্তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় জিগনার।
একটি আইন সংস্থায় (ল ফার্ম) ইন্টার্ন হিসাবে যুক্ত হন জিগনা। সেই সময় জিগনার বাড়ি থেকে সম্বন্ধ করে বিয়ে ঠিক করা হয়। পাত্র পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। গুজরাতে একটি ছাপাখানাও ছিল তাঁর। অন্তত বিয়ের আগে তাই জানতেন জিগনা।
কিন্তু বিয়ের পর জিগনার সামনে থেকে অসত্যের কুয়াশা ধীরে ধীরে সরতে থাকে। তাঁর স্বামী যে আদতে নিজের অসত্য পরিচয় দিয়েছেন তা বুঝতে পারেন তিনি। বহু বছর মুখ বুজে সংসার করলেও শেষ পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন জিগনা।
২০০৪ সালে চার বছরের পুত্রসন্তানকে নিয়ে মুম্বইয়ে চলে যান জিগনা। ২০০৫ সালে সাংবাদিক হিসাবে কেরিয়ার শুরু করেন তিনি।
অপরাধজগতের বিভিন্ন খবর প্রকাশ্যে আনতেন জিগনা। ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ মুম্বইয়ের ডন ছোটা রাজনের স্ত্রী সুজাতা নিখলজের গ্রেফতারির খবরও প্রথম প্রকাশ্যে আনেন জিগনা।
জ্যোতির্ময়ের মৃত্যুর পর ২০১১ সালে জিগনার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ তোলে পুলিশ। ছোটা রাজনের দাবি, জিগনা নাকি জ্যোতির্ময়ের বাড়ির ঠিকানা থেকে শুরু করে তাঁর বাইকের নম্বর প্লেটের মতো যাবতীয় তথ্য ছোটা রাজনকে সরবরাহ করেছিলেন।
তদন্তে নেমে পুলিশ দাবি করে, জিগনার সঙ্গে ফোনে ৩৬ বার ছোটা রাজনের কথা হয়। যদিও জিগনার দাবি ছিল, ছোটা রাজনের সঙ্গে তিন বার কথা হয়েছিল তাঁর। তার মধ্যে এক বার ফোন কেটে যায়। এক বার অফিসের ফোনে কথা হয়। জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে পেশাগত শত্রুতা ছিল বলেই জিগনা সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য ছোটা রাজনকে দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন ছোটা রাজন নিজেই।
ন’মাস জেলবন্দি থাকার পর ২০১২ সালে জামিনে ছাড়া পান জিগনা। ২০১৬ সালে জ্যোতির্ময় দে খুনের তদন্তের দায়িত্ব পায় সিবিআই।
জিগনা জানান, বিশেষ সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্যই তিনি ছোটা রাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু ছোটা রাজন দাবি করেন, জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে পেশাগত শত্রুতা থাকার কারণে তাঁকে ব্যবহার করে নিজের প্রতিযোগীকে খুনের পরিকল্পনা করেছিলেন জিগনা।
আদালতের রায়ে জিগনা নির্দোষ প্রমাণিত হন। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ছোটা রাজনের ঠিকানা হয় দিল্লির তিহাড় জেল।
শুধু জ্যোতির্ময় নন। একাধিক খুন, রাহাজানি এবং মাদক চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে ছোটা রাজনের বিরুদ্ধে। ডন দাউদ ইব্রাহিমের একদা সঙ্গী রাজন পরবর্তীতে দাউদের প্রধান শত্রুতে পরিণত হন। ২০১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় গ্রেফতার হন রাজন। তার পর তাঁকে ভারতে প্রত্যর্পণ করা হয়।
জিগনা তাঁর লেখা বইয়ে নিজের কেরিয়ারের পাশাপাশি জেলবন্দি দশার অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন। জিগনা জানান, ঋতুস্রাব চলাকালীন মহিলা কনস্টেবলদের সামনে তাঁকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়াতে হত।
যে দীর্ঘ ন’মাস জিগনা জেলে ছিলেন, সে সময় ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে পারেননি বলে দাবি করেন তিনি। জিগনা তাঁর বইয়ে লেখেন, ‘‘একটি অ্যালুমিনিয়াম প্লেটের উপর দু’খানা রুটি, ডাল এবং সব্জির তরকারি থাকত। বেশির ভাগ সময় ডালের উপর ভেসে উঠত চুল। জেলে অনেক সময় না খেয়ে কাটাতাম।’’
জিগনা বর্তমানে তাঁর পুত্রকে নিয়ে মুম্বইয়ে থাকেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আর সাংবাদিকতায় ফেরেননি তিনি। তাঁর লেখা বইয়ের উপর বানানো ‘স্কুপ’ ওয়েব সিরিজ়ের বিরুদ্ধে বম্বে হাই কোর্টে মানহানির মামলা দায়ের করেছেন জেলবন্দি ছোটা রাজন।
ছোটা রাজনের দাবি, সিরিজ়ের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। এখানে তাঁর নাম ব্যবহার করে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। লাভের আশায় এই কাজ করছেন নির্মাতারা, এমনটাই জানিয়েছেন ছোটা রাজন।
তবে মানহানির জন্য ছোটা রাজন আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবি করলেও তার পরিমাণ খুবই সামান্য। মাত্র ১ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন তিনি। যদিও ছোটা রাজন দাবি করেছেন, এই সিরিজ় থেকে নির্মাতারা যে অর্থ লাভ করবেন, তা সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্যে খরচ করতে হবে।