গয়না থেকে মন্দির, সাজানোর জিনিস থেকে শুরু করে প্রাসাদ— সব কিছুই সোনা, রুপো, হিরে, পান্না দিয়ে তৈরি। পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে থেকেই সারা বিশ্বে ধনরত্নের ভান্ডার হিসাবে নজির গড়েছিল ইনকা সভ্যতা। কিন্তু যুদ্ধ, বহিরাগতদের আক্রমণ, ধনরত্ন লুটের পর এই সভ্যতা ধ্বংস হয়।
বর্তমান দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে গড়ে উঠেছিল ইনকা সভ্যতা। মনে করা হয়, ১৪৩৮ সালের আগে এই সভ্যতার সূচনা হয়। ধনরত্নের কোনও অভাব ছিল না ইনকাদের।
ইতিহাসবিদদের দাবি, ইনকা সভ্যতা ধ্বংস হলেও তার ধনসম্পদ এখনও লুকোনো রয়েছে কোথাও। এই গুপ্তধনের সন্ধানে বহু অভিযাত্রী পাড়ি দিলেও তাঁরা ধনরত্নের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাননি। অনেকে আবার নিরুদ্দেশ হয়েছেন। অনেকের দাবি, ইনকা সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অভিশাপ।
জনশ্রুতি, ৩৭০০ কোটি আমেরিকান ডলার মূল্যের সোনা সঞ্চিত রয়েছে ইনকা সভ্যতার গুপ্তধনের পাহাড়ে। কেউ বলেন, এই গুপ্তধন রয়েছে ঘন অরণ্যের ভিতর, কারও দাবি, পাহাড়ের মধ্যে কোনও গুহার ভিতর রয়েছে এই বহুমূল্য গুপ্তধন।
কারও মতে, ইনকা সভ্যতার ধনরত্ন যাতে অন্য কারও হাতে না পড়ে, সে কারণে কিছু অংশ ফেলে দেওয়া হয়েছিল এক হ্রদের জলে। কিছু অংশ নাকি আগ্নেয়গিরির ভিতর ফেলে দেওয়া হয়।
ইতিহাসবিদদের দাবি, গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গার কাছাকাছি পৌঁছলেও গুপ্তধন হাতের নাগালে আসেনি অন্বেষণকারীদের। বরং তাঁদের অনেকের মৃত্যু হয়েছিল, অনেকে আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। এর নেপথ্যে ইনকা সভ্যতার ‘অভিশাপ’ রয়েছে বলেই অনুমান ইতিহাসবিদদের একাংশের।
১৫৩২ সালের ঘটনা। সেই সময় ইনকা সভ্যতার সম্রাট ছিলেন আতাহুয়ালপা। ইনকা সভ্যতার ধনসম্পত্তির খবর পেয়ে সেখানে আক্রমণ করেন স্পেনীয় অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো পিজ়ারো। কাহামার্কার যুদ্ধে আতাহুয়ালপাকে পরাজিত করেন পিজ়ারো।
পিজ়ারোর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রচুর। যুদ্ধে কোনও ভাবেই তাঁকে টেক্কা দেওয়া সম্ভব ছিল না আতাহুয়ালপার পক্ষে। তাই পিজ়ারোর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
প্রাণ বাঁচাতে পিজ়ারোকে ঘরভর্তি সোনা এবং রুপো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আতাহুয়ালপা। স্থির হয়, ওই ঘরে যে পরিমাণ সোনা থাকবে, তার চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ থাকবে রুপো। এমনটাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আতাহুয়ালপা। তার পরিবর্তে তাঁকে প্রাণে না মারার প্রতিশ্রুতি দেন পিজ়ারো।
চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্সিসকোকে ঘরভর্তি ধনরত্ন দান করেছিলেন আতাহুয়ালপা। কিন্তু লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিলেন পিজ়ারো। ইনকা সভ্যতার সমস্ত সম্পত্তি অধিকার করতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৫৩৩ সালে আতাহুয়ালপাকে হত্যা করেন পিজ়ারো।
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৫ ক্যারাট সোনা দিয়ে তৈরি ৮৩ কিলোগ্রাম ওজনের সিংহাসনে বসতেন আতাহুয়ালপা। সেই সিংহাসনের দিকে নজর ছিল পিজ়ারোর। আতাহুয়ালপার মৃত্যুর পর সেই সিংহাসন দখল করেন তিনি। লুটপাট চালিয়ে সোনা এবং রুপোর তৈরি যাবতীয় জিনিস দখল করে সেগুলিকে গলিয়ে ফেলেন তিনি।
হাজার হাজার কিলোগ্রাম সোনা পেয়েছিলেন পিজ়ারো। তাঁর সেনাদের মধ্যে সেই সোনা ভাগ করে দিয়েছিলেন তিনি। ইতিহাসবিদদের দাবি, সবচেয়ে নিম্নপদের সেনাও ২০ কিলোগ্রাম ওজনের সোনা পেয়েছিলেন।
ধনরত্নের ২০ শতাংশ নিজের কাছে রেখেছিলেন পিজ়ারো। সেই সম্পদ স্পেনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। ১৫৩৪ সালে পিজ়ারো তাঁর ভাই হার্নান্দোকে সঞ্চিত সম্পদ সমেত স্পেনে পাঠান। বহু দিন সেই ধনরত্ন অটুট থাকলেও পরে তা গলিয়ে ফেলা হয়।
ইনকাদের প্রাণকেন্দ্র ছিল কাসকো শহর। সেনা নিয়ে সেই শহরের দিকে এগোতে শুরু করেন ফ্রান্সিসকো। সেখানে গিয়েও লুটপাট চালান তিনি।
কাসকো শহরের অধিবাসীরা সোনা এবং রুপোর নানা রকম মূর্তি তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শহর আক্রমণ করে নাকি ৩০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি ১২ ইঞ্চি উচ্চতার সোনার নারীমূর্তি হস্তগত করেন ফ্রান্সিসকো।
ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, ফ্রান্সিসকো লুটপাট চালালেও ইনকা সভ্যতার সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে স্পেনে ফিরে যেতে পারেননি। ইনকারা নাকি তাঁদের ধনরত্নের অধিকাংশই লুকিয়ে রেখেছিলেন।
আদতে কোথায় সেই অমূল্য ধনসম্পদ লুকোনো রয়েছে, তার সন্ধান কেউ জানেন না। বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা চালালেও সেই গুপ্তধনের সন্ধান পাননি কেউ। অনেকে আবার দাবি করেন, সন্ধান পেলেও সেই সম্পদ নিয়ে ফিরে আসতে পারেননি তাঁরা। কেউ মারা গিয়েছেন, তো কেউ নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন বলে দাবি ইতিহাসবিদদের।
তবে ইনকা সভ্যতার সম্পদের কিছু অংশ এখনও অক্ষত রয়েছে। পেরুর রাজধানী লিমার একটি জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে ইনকা সভ্যতার বহু মূল্যবান নিদর্শন।