বয়স ৮১ বছর। মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে। কিন্তু দৃষ্টি টানটান। পরনের লালপেড়ে শাড়ির খুঁট কোমরে গোঁজা। বিপক্ষকে চোখ দিয়ে মেপে নিচ্ছেন। এক হাতে তরবারি ঝলসে উঠেছে, অন্য হাতে ঢাল!
তরবারি হাতে এই বৃদ্ধার নাম মীনাক্ষী আম্মা। বয়সে তিনি অশীতিপর। কিন্তু কাজে আঠারো। দৃপ্ত চেহারার মীনাক্ষী ভারতীয় মার্শাল আর্টে মহিলাদের ফিরিয়ে আনছেন।
পোশাকি নাম ‘কলারিপায়াত্তুর’। আদতে ভারতীয় মার্শাল আর্ট। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন এই খেলা আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ।
উত্তর কেরলের একটি ছোট শহর ভাদাকারা। সেখানে একটি আখড়ার গুরু মীনাক্ষী। ছাত্রীর সংখ্যাও নেহাদ মন্দ নয়।
এক ছাত্রী এগোচ্ছেন তলোয়ার হাতে। কোপ মারতে উদ্যত হতেই অসাধারণ কৌশলে তাঁকে মাটিতে ফেলে দিলেন ৮১ বছরের মীনাক্ষী! শিষ্যকুলের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা। সবার কাছে জলজ্যান্ত বিস্ময়।
খুব ছোট থেকে এই অস্ত্রশিক্ষা নিয়েছেন মীনাক্ষী। এই ৮১ বছর বয়সে এসে নিজেকে ছাত্রী হিসেবেই দেখতে ভালবাসেন তিনি। চান আরও বেশি মহিলা এই প্রাচীন ভারতীয় মার্শাল আর্ট রপ্ত করুক।
কলারিপায়াত্তুরের বাংলা তর্জমা রণাঙ্গন বা যুদ্ধক্ষেত্র। দক্ষিণ ভারতের বহু পুরনো এই খেলাকে প্রাচীন ভারতের মার্শাল আর্ট বলা যায়। কেরল, কর্নাটক, তামিলনাড়ুতে ব্যাপক জনপ্রিয় এই খেলা।
হাজার হাজার বছর আগে কেরলের নাইয়ার সম্প্রদায় এই কলারিপায়াত্তুর খেলত। শুধু তরবারি চালনা নয়, খালি হাত, লাঠি, ধারালো বস্তু দিয়েও এই প্রশিক্ষণ হয়। এই খেলায় ক্ষিপ্রতা বাড়ে। টানটান হয় চেহারা।
মীনাক্ষী আম্মার কথায়, ‘‘নিছক খেলা নয়। কলারিপায়াত্তুর হল একটা শিল্প।’’ কেমন শিল্প?
৮১ বছরের মীনাক্ষীর ব্যাখ্যা, ‘‘কলারিপায়াত্তুর আসলে দুই শিল্পের মিশ্রণ। নাচের চারুতা এবং যোদ্ধার ক্ষিপ্রতা, এই দু’য়ের মিশেল হল কলারিপায়াত্তুর।’’
এই বয়সেও তিনি ঝকঝকে, কর্মক্ষম। মীনাক্ষী বলছেন সবই কলারিপায়াত্তুরের জন্য। তিনি জানান, শরীর এবং মনকে তরতাজা রাখতে কালারিপায়াত্তুরের জুড়ি নেই।
দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং কলারিপায়াত্তুর প্রশিক্ষক চিরাক্কল টি শ্রীধরণ নায়ারের মতে, ‘‘শতাব্দীর পর শতাব্দী কেরলের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলারিপায়াত্তুর।’’ তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, আগে কলারিপায়াত্তুরের মাধ্যমেই নাকি পরিবারের মধ্যে বিরোধেরও নিষ্পত্তি হত।
এক সময় দক্ষিণ ভারতের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই প্রশিক্ষণ নিত। তাঁদের নিয়ে বহু বীরগাথা রয়েছে।
পঞ্চদশ শতকের পর কলারিপায়াত্তুরের চল ক্রমশ কমতে থাকে। পর্তুগিজরা ভারতে আসার পর নতুন নতুন অস্ত্র আসে। তখন প্রাচীন এই অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিক্ষার চাহিদা কমে যায়।
কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেয় ব্রিটিশরা। উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে আধুনিক সব অস্ত্র আসতে শুরু করে। ইংরেজ শাসনকালে নিষিদ্ধ করা হয় কলারিপায়াত্তুরকে।
স্বদেশি আন্দোলনের সময় আবার ফিরে আসে এই অস্ত্রবিদ্যা। ভারতের প্রাচীন মার্শাল আর্টকে আঁকড়ে ধরেন প্রচুর মানুষ। দক্ষিণ ভারতের গ্রামের পর গ্রামে এর প্রশিক্ষণ শুরু হয়। খোলা হয় আখড়া।
মীনাক্ষী আম্মা তাঁদেরই উত্তরসূরি। তাঁর কথায়, ‘‘সাত বছর বয়সে আমি কলারিপায়াত্তুর শেখা শুরু করি। ভরতনাট্যম শিখতাম। সেই শিক্ষকের পরামর্শে বাবা আমাকে এই প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তাঁর গুরু ছিলেন প্রখ্যাত ‘শিল্পী’ ভিপি রাঘবন। তাঁর সঙ্গেই পরে বিয়ে হয় মীনাক্ষী আম্মার।
সে সময় বাল্যবিবাহের চল। অল্প বয়সে মা হয়ে সংসার করতেন মহিলারা। কিন্তু মীনাক্ষী ছিলেন আলাদা। বিয়ের পর স্বামীর কাছে চলত তাঁর কলারিপায়াত্তুর প্রশিক্ষণ।
মীনাক্ষীর কথায়, ‘‘কলারিপায়াত্তুর থেকে এক বারই দূরে গিয়েছিলাম। তখন আমি সন্তানসম্ভবা ছিলাম। তার পরে আবার এই শিল্পকে আঁকড়ে ধরেছি।’’
মীনাক্ষী আম্মার দৌলতে দক্ষিণ কেরলে আবার ফিরছে কলারিপায়াত্তুর। বহু পরিবার তাদের মেয়েদের নিয়ে চলে আসছেন মীনাক্ষীর আখড়ায়।
২০০৯ সাল থেকে স্বামীর আখড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন মীনাক্ষী। কেরল তো বটেই, সারা ভারতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর ছাত্র-ছাত্রী।
২০১৭ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত হন মীনাক্ষী আম্মা। তাঁর দাবি, এই সম্মানপ্রাপ্তির পর তাঁর শিল্প নিয়ে আরও আগ্রহ বাড়ে মানুষের। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
মীনাক্ষীর কথায়, ‘‘নিজের সুরক্ষা নিজেকে করতে হয়। সবই মেয়ের কলারিপায়াত্তুর শেখা উচিত। শুধু ক্ষমতায়ন নয়, শারীরিক সক্ষমতা, একাগ্রতা, নিজের শরীর এবং মনের উপর নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।’’