আঁকাবাঁকা রাস্তা থেকে গ্রামের আলপথ দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলেছেন এক প্রৌঢ়া। পরনে সাদা শাড়ি। এক হাতে ফাইল, পিঠে একটা বড় ঝোলা। তাতে নানা কিসিমের বই। এই মহিলার নাম রাধা। ভিপি রাধা। কেরলের পায়ান্নুর যাঁকে চেনে ‘চলন্ত পাঠাগার’ নামে। কেন এমন অদ্ভুত নাম? কী করেন এই প্রৌঢ়া?
এই ইন্টারনেটের যুগে বই পড়ার অভ্যাস কমে গিয়েছে মানুষের। বাড়িতে একা থাকলেও মানুষের সঙ্গী হয় টিভি বা মোবাইল ফোন। বিশেষত, গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে উদ্যোগী হয় কেরলের পায়ান্নুর পুরসভা। উদ্যোগটা হল, বধূদের জন্য বাড়ি-বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া। পুরসভার তরফে এই কাজের জন্য নিয়োজিত হন রাধা।
৫৭ বছর বয়সি রাধা নিজে বইয়ের পোকা। তবে ‘চলমান পাঠাগার’-এর কাজটা নিয়েছিলেন খানিকটা সাংসারিক চাপে। একটা কোম্পানির কাজ করতেন। কিন্তু তাতে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালাতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। তাই একটা পার্ট টাইম কাজ খুঁজছিলেন রাধা।
স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে বই নিয়ে বাড়ি-বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া— এমন কাজ করতে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি কেউ। এগিয়ে এসেছিলেন এক প্রৌঢ়া। তিনিই কাঁধে নেন বইয়ের বড় ঝোলা।
সেই ২০০২ সাল থেকে অলিগলি-পাড়া অনেক হেঁটেছেন ৫৭ বছরের মহিলা। দু’দশক কেটে গিয়েছে। এখনও একই রকম আগ্রহের সঙ্গে কাজ করছেন রাধা। প্রতি দিন ঝোলাভর্তি বই নিয়ে বেরোন। বাড়ি-বাড়ি অর্ডারি বই পৌঁছে দেন। আবার, কেউ কোনও বইয়ের নাম বললে সেগুলো লিখে নিয়ে লাইব্রেরি যাওয়া ও পরের দিন সেই বই তাঁর হাতে পৌঁছে দেওয়া— এটাই রাধার কাজ।
রাধার কথায়, ‘‘এক সময় অতিরিক্ত রোজগারের আশায় এই কাজটা নিয়েছিলাম। এখন ছেলেমেয়েরা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমি এই কাজটাকে ভালবেসে ফেলেছি।’’
এই কাজ করেই রাধা মেয়ে রঞ্জিনীর বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে সাজন পড়াশোনা করে সরকারি কর্মচারি হয়েছেন। তবে তাঁরাও জানেন, মা এই কাজ করেন ভালবাসা থেকে। তাই কেউ বাধা দেননি।
প্রথম যখন পুরসভা এই চলমান গ্রন্থাগারের উদ্যোগ আনল, গ্রামবাসীদের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। রাধা জানান, প্রথম প্রথম তাঁকে আমল দিতেন না কেউ। কিছু দিন পর গ্রাহক সংখ্যা হয় ৬০।
যত দিন গিয়েছে, বই পড়ার নেশা তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। এখন কয়েকশো গৃহিণী নিয়মিত তাঁর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়াশোনা করেন। সবাই অবসরের সঙ্গী করেছেন রাধার পৌঁছে দেওয়া বইকে।
বয়স হচ্ছে। কিন্তু রাধা এখনও হেঁটে চলেছেন। এখন তো আর পরিবারে অর্থাভাব নেই। কেন করেন এই কাজ? রাধার উত্তর, ‘‘বইয়ের গন্ধ ভাল লাগে।’’
রাধা বলেন, ‘‘হয়তো এমনই একটা কাজ আমি সারা জীবন করতে চেয়েছিলাম। বই ভর্তি ঝোলাটাকে কাঁধে নিয়ে কখনও ভার অনুভব করিনি। বইয়ের গন্ধ, বই নেড়েচেড়ে দেখা, পড়া, সেগুলো পাঠকদের দেওয়া এবং সংগ্রহ করা— এই কাজ আমাকে ভীষণ আনন্দ দেয়।’’