কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ থেকে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ, এবং তার পরের অগণিত ঐতিহাসিক ঘটনার এক সাক্ষী আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাংড়া দুর্গ। ইতিহাস বইয়ের শুকনো পাতা অতিক্রম করে আজও বিভিন্ন কারণে মানুষকে আকর্ষণ করে চলেছে এই কেল্লা। তার মধ্যে অন্যতম হল এর গুপ্তধনের কাহিনি।
হিমাচল প্রদেশের কাংড়া শহরের নিকটবর্তী জনপদ ধর্মশালা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দুর্গের ইতিবৃত্ত পুরাণকে ছুঁয়ে থাকলেও বর্তমানে যে কাঠামোটিকে দেখা যায়, তার নির্মাণ ঘটেছিল খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে।
কাতোচ বংশীয় রাজা সুশর্মা চন্দ্র এই স্থানে দুর্গ নির্মাণ করান ‘মহাভারত’-এর কালে— এমন লোকবিশ্বাস আজও বহমান। কাতোচরাজ সুশর্মা বেদব্যাসের মহাকাব্যে খুব বেশি জায়গা জুড়ে না থাকলেও এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে তিনি যুক্ত। ঘটনাটি ঘটেছিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ চলাকালে।
সুশর্মা কৌরবদের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধের ত্রয়োদশতম দিনে অর্জুনপুত্র মহাবীর অভিমন্যুকে বধ করার পরিকল্পনা করেন কৌরবরা। অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য অভিমন্যুকে এক চক্রব্যুহ সৃষ্টি করে ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা করেন। দ্রোণের এই ব্যুহ ভেদ করার কৌশল মাত্র দু’জন ব্যক্তিই জানতেন। কৃষ্ণ এবং অর্জুন। অভিমন্যুকে ব্যুহ ভেদে তাঁরা যাতে সহায়তা না করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কৌরবদের পক্ষে একান্ত ভাবে প্রয়োজনীয় ছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন ও তাঁর সারথী কৃষ্ণকে চক্রব্যুহে আবদ্ধ অভিমন্যুর কাছ থেকে দূরে রাখার দায়িত্ব নেন কাতোচরাজ সুশর্মা। তিনি কৃষ্ণ ও অর্জুনকে অন্যত্র ব্যস্ত রাখেন। সেই সুযোগে দ্রোণাচার্য অন্য মহারথীরা অভিমন্যুকে বধ করেন।
কাতোচরাজ সুশর্মা সম্পর্কে ‘মহাভারত’-এর বিরাট পর্বেও উল্লেখ রয়েছে। তিনি দুর্যোধনের সম্পর্কিত শ্যালক। তিনি ছিলেন ত্রিগর্তের (বর্তমানে কাংড়া) শাসক। সুশর্মা বিরাট রাজের গোধন হরণ করলে বিরাট তাঁকে আক্রমণ করেন। সুশর্মা বিরাটকে পরাজিত ও বন্দি করেন। পাণ্ডবরা তখন অজ্ঞাতবাসে বিরাট রাজের আশ্রয়ে রয়েছেন। যুধিষ্ঠির ভীমকে বলেন বিরাটকে মুক্ত করতে। ভীম সুশর্মাকে আক্রমণ করেন এবং পরাস্ত করে বিরাটকে মুক্ত করেন। সুতরাং সুশর্মার সঙ্গে পাণ্ডবদের শত্রুতা আগে থেকেই ছিল।
এক কিংবদন্তি অনুসারে কাতোচ রাজবংশের উদ্ভবের কাহিনিও বেশ রোমাঞ্চকর। রক্তবীজ অসুরকে নিধন করতে যখন দেবী অম্বিকা যুদ্ধে রত হন, তখন তাঁর স্বেদবিন্দু থেকে জন্ম নেন প্রথম কাতোচ। তিনি রক্তবীজ সংহারে দেবীকে সাহায্য করেন। পরিবর্তে দেবী তাঁকে ত্রিগর্তের রাজপদ দান করেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবরা পরাজিত হলে সুশর্মা তাঁর রাজ্য ত্রিগর্তে ফিরে যান এবং কাংড়া দুর্গ নির্মাণ করান। সম্ভবত তিনি পাণ্ডবদের দিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করছিলেন।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, সেই মহাভারতীয় কাল থেকেই কাতোচ রাজারা এই দুর্গে তাঁদের বিপুল ধনরত্ন সঞ্চয় করতে শুরু করেন। পরে যখন এখানে নতুন দুর্গ-কাঠামো গড়ে তোলা হয়, তখন তার অভ্যন্তরে বেশ কিছু মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন রাজারা। সেই সব মন্দিরেই রাজারা তাঁদের ধনসম্পদ গচ্ছিত রাখতে শুরু করেন। তা ছাড়াও, বিভিন্ন ধনী ব্যক্তিও যুগ যুগ ধরে এখানে সোনা বা মূল্যবান রত্ন দান করতে থাকেন।
এই সব ধনরত্ন নাকি ২১টি কুয়োর ভিতরে সঞ্চিত রাখা হয়। এই কুয়োগুলি চার মিটার গভীর ছিল। মধ্যযুগের ইতিহাসের অন্যতম উপাদান ‘তারিখ-ই-ফিরিস্তা’ থেকে জানা যায়, বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা, সোনা ও রূপার পাত এবং মুক্তা, হিরে, চুনি ও অন্যান্য দামি পাথর সেই সব কুয়োয় রাখা হয়েছিল।
এই ধনরত্নের কাহিনি আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে গজনির সুলতান মামুদের মতো বিদেশি আক্রমণকারীদের যে কাংড়া দুর্গের প্রতি নজর দিতে বাধ্য করেছিল, তা বিভিন্ন সময়ের বিবরণ থেকে জানা যায়। মুঘল সম্রাট আকবরের বাহিনী ৫২ বার এই দুর্গ আক্রমণ করেছিল বলে কথিত আছে। তার আগে কাশ্মীরের রাজা, সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক এবং ফিরোজ শাহ তুঘলকও কাংড়া দুর্গ আক্রমণ করেন বলে জানা যায়। তবে এই সব আক্রমণের বেশির ভাগই সফল হয়নি।
বেশ কিছু জনশ্রুতি বলে, গজনির সুলতান মামুদ দুর্গে প্রবেশ করে কিছু রত্নকূপ লুণ্ঠন করেন। উনিশ শতকে ব্রিটিশ বাহিনীও নাকি ব্যাপক লুঠতরাজ চালায় এই দুর্গে। তবে এ কথাও সত্য যে, আকবরের পুত্র জহাঙ্গির কাংড়া দুর্গ অধিকারে সমর্থ হন। কিন্তু কিছু দিন পরেই কাতোচ বংশীয় রাজা সংসার চাঁদ দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। তারও পরে শিখ সেনারা দুর্গ দখল করে। শেষ পর্যন্ত কাংড়া দুর্গ ব্রিটিশ অধিকারে চলে যায়।
ব্রিটিশ অধিকারে থাকাকালীনই ১৯০৫-এর এপ্রিলে কাংড়া দুর্গ এক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্গের অনেকখানিই এর ফলে ভেঙে পড়ে। তবু দুর্গের ভিতরে অবস্থিত অম্বিকা দেবীর মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির এবং জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের মন্দির প্রায় অক্ষতই থাকে। দুর্গের ১১টি প্রবেশদ্বার আজও অটুট রয়েছে।
দুর্গের দীর্ঘ ইতিহাসে বারবার লুঠতরাজের ঘটনা ঘটলেও জনশ্রুতি এই যে, আটটি রত্নকূপ নাকি আজও এই দুর্গে সবার অগোচরে থেকে গিয়েছে। এই আটটি কুয়োর সন্ধানে অনেকেই অভিযান চালিয়েছেন কাংড়া দুর্গে। কিন্তু সেগুলির সন্ধান পাওয়া যায়নি।