একটা সময়ে আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে জলের বোতল বিক্রি করতেন তিনি। তার পর একদিন হাতে তুলে নিলেন হকি স্টিক। মাঠে জাদু দেখাতে শুরু করায় গায়ে উঠল জাতীয় দলের জার্সি। আর এ ভাবেই নতুন তারকাকে পেল ভারতীয় পুরুষ হকি দল।
তিনি, যুগরাজ সিংহ। যাঁর গোলে চিনকে হারিয়ে ফের একবার পুরুষদের হকিতে এশিয়া সেরা হয়েছেন হরমনপ্রীতেরা। তবে যুগরাজের জাতীয় দলের সফর কোনও রূপকথার চেয়ে কম নয়।
চলতি বছরের এশিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপ ট্রফির আয়োজন করেছিল চিন। টুর্নামেন্টের গোড়া থেকেই স্বপ্নের ফর্মে ছিলেন হরমনপ্রীতেরা। একের পর এক দলকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠেন তাঁরা। চ্যাম্পিয়ানশিপের ম্যাচে আয়োজকদের মুখোমুখি হয় ভারত।
এই টুর্নামেন্টের গ্রুপের খেলায় টিম ইন্ডিয়ার সামনে দাঁড়াতেই পারেনি চিন। কিন্তু, ঘরের মাঠে ফাইনালে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে শি জিনপিংয়ের দেশ। প্রথম তিনটি কোয়ার্টারে ‘চিনের প্রাচীর’ ভেঙে গোলের মুখ খুলতেই পারেননি হরমনপ্রীত-রাজকুমারেরা।
চতুর্থ কোয়ার্টারের শুরু থেকেই আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়িয়েছিল ভারত। যার ফল মেলে হাতেনাতে। ২৭ বছরের যুগরাজ জোরালো শটে চিনের জালে বল জড়িয়ে দেন। ম্যাচ তখন ৫১ মিনিটে গড়িয়েছিল। যুগরাজের ওই গোলেই টানা পঞ্চমবার এশিয়া সেরার মুকুট উঠেছে ভারতের মাথায়।
টিম ইন্ডিয়ার এই তরুণ খেলোয়াড়কে সেন্ট্রাল ব্যাকে রেখেই সব সময় দল সাজান কোচ ক্রেগ ফুলটন। মাঝমাঠে বলকে নিয়ন্ত্রণে রেখে খেলা তৈরি করতে পারেন তিনি। নিজে গোল করার চেয়ে গোল করানোয় যুগরাজের জুড়ি মেলা ভার।
এ হেন প্রতিভাবান হকি খেলোয়াড়ের ছোটবেলা কেটেছে চরম দারিদ্রে। তাঁর বাবা সুখজিৎ সিংহ প্রায় ৩০ বছর কুলির কাজ করেছেন। ছেলে যুগরাজ এশিয়া চ্যাম্পিয়ানশিপের ফাইনালে গোল করায় রীতিমতো উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি। তাঁর ছোটবেলার লড়াইয়ের গল্প সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেছেন সুখজিৎ।
যুগরাজের পরিবারের দাবি, আর্থিক সঙ্কট মেটাতে প্রতিভাবান এই হকি খেলোয়াড়কে নানা ধরনের কাজ করতে হয়েছে। একটা সময়ে নিয়মিত জাতীয় পতাকা ও জলের বোতল বিক্রি করতেন তিনি। এতে যা রোজগার হত তার পুরোটা সংসার খরচের জন্য দিয়ে দিতেন যুগরাজ।
আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে প্রতি দিন ‘বিটিং দ্য রিট্রিট’-এর আয়োজন করে বিএসএফ। যা দেখতে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বহু মানুষ ভিড় জমান। ছোটবেলায় পরিবারের আর্থিক সঙ্কট মেটাতে সেখানেই জাতীয় পতাকা ও জলের বোতল বিক্রি করতেন যুগরাজ।
টিম ইন্ডিয়ার এই সেন্ট্রাল ব্যাকের বাবা জানিয়েছেন, ‘‘ওর জন্য আমরা গর্বিত। আমি তো কায়িক পরিশ্রম ছাড়া আর কিছুই করতে জানি না। ও যে এখানে পৌঁছে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু এটা যুগরাজ করে দেখিয়েছে।’’
সীমান্তে জাতীয় পতাকা ও জলের বোতল বিক্রির পাশাপাশি পাড়ায় খেলাধুলো করতেন যুগরাজ। সেখানেই একদিন কোচ নভজিৎ সিংহের নজরে পড়ে যান তিনি। নভজিতের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় তাঁর হকির প্রকৃত প্রশিক্ষণ। যদিও তা অ্যাস্ট্রোটার্ফে নয়। সরকারি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের ঘাসের মাঠেই অনুশীলন করতেন ভারতীয় দলের এই নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়।
যুগরাজের প্রথম জীবনের কোচ নভজিৎ জানিয়েছেন, ‘‘ছোট থেকেই ও ছিল মারাত্মক পরিশ্রমী। হকিটা ওর রক্তে আছে। অন্য খেলোয়াড়দের থেকে শারীরিক শক্তিতে বরাবরই এগিয়ে ছিল যুগরাজ। সেটা হয়তো বাবার সঙ্গে ভারী কাজ করার জন্যই হয়েছিল।’’
নভজিতের কোচিংয়ে অল্প দিনের মধ্যেই যুগরাজের হকির প্রতিভার বিচ্ছুরণ হতে থাকে। ভাল কিটের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। এর জন্য ইংল্যান্ড ও কানাডার বন্ধুদের কাছে সাহায্য চান নভজিৎ। মূলত, তাঁদের চেষ্টাতেই আন্তর্জাতিক মানের হকির কিট যুগরাজের হাতে তুলে দেন কোচ নভজিৎ।
নভজিৎ বলেন, ‘‘প্রতি দিন খুব সকালে ও অনুশীলনের জন্য চলে আসত। বেলা বাড়লে চলে যেত আটারি-ওয়াধা সীমান্তে। সেখানে জাতীয় পতাকা ও জলের বোতল বিক্রি করেই ফের চলে আসত মাঠে। বিকেলের দিকটায় ফের চলত অনুশীলন। কোনও দিন রাত পর্যন্ত অনুশীলন করলেও পরের দিন মাঠে আসতে একবারও দেরি করেনি যুগরাজ।’’
২০০৯ সালে পঞ্জাবের খাদুর সাহিব এলাকায় বাবা উত্তম সিংহ জাতীয় হকি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন যুগরাজ। সেখানেই লম্বা সময়ের জন্য নেন প্রশিক্ষণ। চার বছরের মাথায় নেহরু কাপে খেলার সুযোগ পান তিনি।
নেহরু কাপে নজরকাড়া পারফরম্যান্সের পর জাতীয় দলে সুযোগ পেতে কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যান যুগরাজ। ২০২১-২২ সালের এফআইএইচ হকি প্রো লিগে ভারতীয় দলে অভিষেক হয় তাঁর।
২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ভারতীয় দলের হয়ে এখনও পর্যন্ত ৫৭টি ম্যাচ খেলেছেন যুগরাজ। মোট ১৬টি আন্তর্জাতিক গোল রয়েছে তাঁর। মাঝমাঠের পাশাপাশি রক্ষণভাগেও তাঁকে খেলতে দেখা গিয়েছে।
২০২২ সালের কমনওয়েলথ গেমসে রুপো পায় ভারত। এ ছাড়া ২০২৩ সালে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপে সোনা জিতেছিল টিম ইন্ডিয়া। দু’টি টুর্নামেন্টেই জাতীয় দলের জার্সিতে মাঠে নেমেছিলেন যুগরাজ।