হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কৌতুকশিল্পী রাজু শ্রীবাস্তব। জিমে শরীরচর্চা করার সময় হঠাৎই বুকে ব্যাথা নিয়ে দিল্লি এমসে ভর্তি হন তিনি। এর পর থেকে ধীরে ধীরে রাজুর শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়। জ্ঞান হারান। কাজ করা বন্ধ করেছে মস্তিষ্কও। এখন ভেন্টিলেশনেই আছেন শিল্পী।
উন্নতির শিখরে ওঠা এই শিল্পী নিজের কৌতুকরসের জেরে সহজেই জায়গা করে নিয়েছেন দেশবাসীর মনে। লোক হাসিয়ে রাজুকে ভারতের অন্যতম সেরা কৌতুকশিল্পী হতে উঠতে সবাই দেখেছেন। কিন্তু যা দেখেননি, তা হল কোন পথে চলে তাঁর জীবনে এই সাফল্য আসে।
১৯৬৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের কানপুরে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাজু। ভাল নাম সত্যপ্রকাশ শ্রীবাস্তব। রাজুর বাবা রমেশচন্দ্র শ্রীবাস্তব ছিলেন একজন কবি। ‘বলাই কাকা’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন রমেশ।
ছোটবেলা থেকেই নামীদামি শিল্পীদের গলা নকল করতে ভালবাসতেন রাজু। আর এই প্রতিভার জেরে এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ইচ্ছে জাগে বড় হয়ে কৌতুকশিল্পী হওয়ার।
যৌবনে পা দিয়েই রাজু ঠিক করেন যে তিনি মুম্বই যাবেন। কানপুরে পড়ে থাকলে তাঁর প্রতিভা যথাযোগ্য সম্মান পাবে না, এই মনে করেই মুম্বই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রাজু। চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে মুম্বই পাড়ি দেন তিনি।
তবে স্বপ্ননগরীতে পা দিয়েই রাজু বুঝতে পারেন, রাস্তা খুব সহজ হবে না। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে আনা টাকা ফুরোয়। চরম অভাব-অনটনের মুখে পড়েন রাজু। ভারতের শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা হওয়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে শুরু করে।
পেটের খিদে মেটাতে নিরুপায় হয়ে অটো চালাতে শুরু করেন রাজু। তবুও হাল ছাড়েননি। এই সময় থেকেই রাজু ছোটখাটো অনুষ্ঠানে কৌতুক পরিবেশন করতে শুরু করেন।
এক সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে রাজু জানিয়েছিলেন, তিনি যখন প্রথম মুম্বই আসেন, তখন কৌতুক অভিনেতা হিসাবে তাঁকে বিশেষ পাত্তা দেওয়া হয়নি। বহু বার কানপুর চলে যাওয়ার কথাও ভাবেন তিনি। কিন্তু বিখ্যাত অভিনেতা তথা কৌতুকশিল্পী জনি লিভারকে দেখে তিনি মনে সাহস পেতেন বলেও রাজু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন।
রাজু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, জীবনে চলার পথে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত তিনি দেখেছেন। এ-ও জানিয়েছিলেন, জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে কৌতুক অভিনেতা হিসাবে কাজ করে প্রারিশ্রমিক হিসাবে তিনি মাত্র ৫০ টাকা করে পেতেন।
জীবনে আসা সমস্ত বাধাবিপত্তি কাটিয়ে কৌতুকশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেন রাজু। এর পর হঠাৎই এক দিন অটো চালানোর সময় রাজুর ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে। একটি হাস্যকৌতুকানুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাজু শ্রীবাস্তবকে।
ডিডি ন্যাশনালের বিখ্যাত কৌতুকানুষ্ঠান ‘টি টাইম মনোরঞ্জন’ থেকে শুরু করে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ’, নিজের বিশেষ পরিচয় তৈরি করেন রাজু। প্রতিভার জোরে খুব সহজেই দেশবাসীর ঘরের ছেলে হয়ে ওঠেন তিনি।
‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ’-এ রাজু দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এই কৌতুকানুষ্ঠানে তিনি ‘গজোধর ভাইয়া’ নামক এক চরিত্রে অভিনয় করে জনগণকে হাসাতেন। রাজুর মতোই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর সৃষ্টি করা চরিত্রটিও।
১৯৯৩ সালে রাজু শিখাকে বিয়ে করেন। অন্তরা এবং আয়ুষ্মান নামে শ্রীবাস্তব দম্পতির দুই সন্তানও আছে।
‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ’-বাদেও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন রাজু। ২০০৯ সালে বিতর্কিত রিয়েলিটি শো ‘বিগ বস’-এর তিন নম্বর সিজনে অংশ নেন রাজু। ২০১৩ সালে স্ত্রীকে নিয়ে যোগ দেন ‘নাচ বলিয়ে সিজন ৬’-এ। ‘দ্য ইন্ডিয়ান মজাক লিগ’-এও অংশ নেন রাজু। এই কৌতুকানুষ্ঠানে বিচারকের আসনে দেখা গিয়েছিল জনপ্রিয় ভারতীয় ক্রিকেটার হরভজন সিংহ এবং পাকস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব আখতারকে। জনপ্রিয় কৌতুকানুষ্ঠান ‘কমেডি নাইটস উইথ কপিল’-এও অতিথি হিসাবে রাজু হাজির হয়েছিলেন।
পাকাপাকি ভাবে কৌতুকশিল্পী হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আগে অনেক বলিউড সিনেমাতে ছোট ছোট চরিত্রেও অভিনয় করেন রাজু। এমনকি, ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া’ এবং ‘বাজিগর’-এর মতো সফল বলি সিনেমাতেও ছোট চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
২০১০ সালে পাকিস্তান থেকে ফোন করে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয় রাজুকে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাকিস্তান এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিমকে নিয়ে কৌতুক পরিবেশন করার জন্য তাঁকে এই হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টির হয়ে কানপুর থেকে প্রার্থী হন রাজু। কিন্তু ওই বছরের ১১ মার্চ তিনি তাঁর প্রার্থিপদ এই বলে বাতিল করে দেন যে, তিনি দলের স্থানীয় ইউনিট থেকে যথেষ্ট সমর্থন পাচ্ছেন না। এর পরে, ১৯ মার্চ বিজেপিতে যোগ দেন রাজু।
পরবর্তীতে ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এর অংশ হিসেবে রাজুর নাম মনোনীত করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে তিনি পরিচ্ছন্ন ভারত গড়ার প্রচার চালিয়েছেন। পরিচ্ছন্নতা প্রচারের জন্য বিভিন্ন মিউজিক ভিডিয়োতেও তিনি কাজ করেছেন।
২০২২-র ১০ অগস্ট ট্রেডমিলে দৌড়তে দৌ়ড়তে রাজু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর এমআরআই রিপোর্ট জানাচ্ছে তিনি ভাল নেই। রিপোর্ট অনুযায়ী তাঁর মস্তিষ্কের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন, যাতে দ্রুত তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়। তবে তাঁরা এ-ও জানিয়েছেন, আগামী ১০ দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সঙ্কটজনক অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগতে পারে ১০ দিনেরও বেশি।
রাজু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মাথায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন কৌতুকশিল্পীর ভাই কাজু শ্রীবাস্তবও।
রাজুর শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য দেশ জুড়ে প্রার্থনা এবং যজ্ঞ শুরু করেছেন তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তেরা।