ভিত কেঁপে গিয়েছে জোশীমঠের। যে দিকে চোখ যায়, শুধু ফাটল আর ফাটল। যে কোনও মুহূর্তে তলিয়ে যেতে পারে হিমালয়ের কোলের এই ছোট্ট জনপদ। ভিটেমাটি ছেড়ে একরাশ অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে অন্যত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই নিতে হয়েছে বাসিন্দাদের। জোশীমঠের মতো এমন ভয়াবহ বিপর্যয় কি উত্তরাখণ্ডের অন্য এলাকাগুলিতেও হতে পারে?
ফাটল ঘিরে জোশীমঠ যখন আতঙ্কের প্রহর গুনছে, সেই সময় যেন অশনি সঙ্কেত পেলেন উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার (এই জেলারই অন্তর্গত জোশীমঠ) কর্ণপ্রয়াগের জনতা।কর্ণপ্রয়াগেরও বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা গিয়েছে। নেমেছে ধস।
কর্ণপ্রয়াগের বহুগুণা নগর এলাকায় প্রায় ৫০টি বাড়িতে ফাটল দেখা গিয়েছে। ফাটলের জেরে ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দা ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আপার বাজার ওয়ার্ডের ৩০টি পরিবার বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে।
ইতিমধ্যেই উত্তরাখণ্ড সরকারের কাছ থেকে সাহায্যের আর্জি জানিয়েছে কর্ণপ্রয়াগের স্থানীয় পুরসভা। তবে জোশীমঠ, কর্ণপ্রয়াগই নয়, এমন বিপর্যয় যে কোনও মুহূর্তে ঘটতে পারে উত্তরাখণ্ডের একাধিক এলাকায়। এমন আশঙ্কার কথাই শুনিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংবাদমাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের বড় একটি অংশ দাবি করেছেন, নিঃশব্দে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে ভূমি অবক্ষয়। বর্তমানে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে জোশীমঠ, আগামী দিনে একই ভয়ঙ্কর ছবি ধরা পড়তে পারে চামোলি জেলার কর্ণপ্রয়াগ, গোপেশ্বর এলাকায়।
শুধু চামোলি জেলাই নয়, তেহরি জেলার ঘানসালি, পিথোরাগড়ের মুন্সিয়ারি, ধারচুলা, উত্তরকাশী জেলার ভাটওয়ারি, পাউরি, নৈনিতাল-সহ উত্তরাখণ্ডের বেশ কয়েকটি শহর বসে যেতে পারে।
কিন্তু কেন ওই এলাকাগুলি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে? এই প্রসঙ্গে হেমবতী নন্দন বহুগুণা গাড়ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ এসপি সতী সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘ওই শহরগুলি থেকে ক্রমাগত ভূমিধসের খবর পাওয়া গিয়েছে। এলাকার ভৌগোলিক দিক বিবেচনা না করেই যত্রতত্র বহুতল নির্মাণ করা হয়েছে।’’
হিমালয়ের কোলে যে জনপদগুলি রয়েছে, সেখানে নির্মাণ কাজের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, তা হলেই জোশীমঠের মতো বিপর্যয়ে পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব হবে বলে মত ওই ভূতত্ত্ববিদের।
জোশীমঠের পাশাপাশি চামোলি জেলার কর্ণপ্রয়াগেও বিপর্যয় দেখা যাওয়ায় আতঙ্কে বাসিন্দারা। বহুগুণা নগর এলাকার এর বাসিন্দা পঙ্কজ ডিমরির কথায়, ‘‘প্রতি বছর বর্ষার সময় কিছু বাড়ি তলিয়ে যায়। ২০২১ সালে চারধাম প্রকল্পের কাজের জন্য কর্ণপ্রয়াগের কাছে পাহাড় কাটা হয়েছে। যার জেরে ধস নামে।’’
সেই সময় কর্ণপ্রয়াগে ফাটল দেখা গিয়েছিল, যা খতিয়ে দেখে বিশেষজ্ঞদের কমিটি। প্রকল্পের কাজের জন্য অবৈজ্ঞানিক ভাবে পাহাড়ে খননকাজ চালানো ও রাস্তা চওড়া করার কাজের জেরেই এই বিপত্তি ঘটে বলে দাবি করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ওই এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজের কারণেই বার বার এমন বিপর্যয় ঘটছে। তাই উন্নয়ন করতে গিয়ে বড়সড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছেন উত্তরকাশী জেলার সুক্কি টপ গ্রামের বাসিন্দারা। আপেলের বাগানের জন্য সুখ্যাতি রয়েছে ওই গ্রামের। হর্ষিল উপত্যকায় গঙ্গোত্রী হাইওয়ের পাশে রয়েছে গ্রামটি। চারধাম প্রকল্পের অংশ হিসাবে একটি বাইপাস তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই বাইপাস তৈরি হলে বিপদ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা গ্রামবাসীদের।
জোশীমঠের মতো ডুবতে পারে নৈনিতালও। এই আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন ‘সেন্টার ফর ইকোলজি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ’-এর ডিরেক্টর বিশাল সিংহ। ১৮৬৭ সাল থেকে সে শহরে ভূমি বিপর্যয়ের একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই শহরের যা ধারণক্ষমতা, সে তুলনায় যে ভাবে যত্রতত্র নির্মাণকাজ হচ্ছে, তা শহরের জন্য বিপজ্জনক। সেই সঙ্গে জনসংখ্যা বাড়ছে। পর্যটকদের ভিড়ও বাড়ছে। সব মিলিয়ে আগামী দিনে বিপর্যয় ঘটতে পারে নৈনিতালে।
নৈনিতালের মতো পিথোরাগড় জেলাও বিপদের মুখে। সেখানেও অতীতে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষত, মুন্সিয়ারি, ধারচুলায় একাধিক ধসের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, মাটির ধারণক্ষমতা যথাযথ ভাবে যাচাই না করেই ভারী নির্মাণকার্য চালানো হয়েছে।
তবে শুধু মাত্র মানুষের দোষেই যে এত বড় বিপর্যয় ঘটছে হিমালয়ের কোলঘেঁষা এই জনপদগুলিতে, তা কিন্তু নয়। এর জন্য দায়ী প্রকৃতির খামখেয়ালিপনাও। অতিবৃষ্টিতে ভূমিক্ষয় এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবেশবিদ মল্লিকা ভানোট জানিয়েছেন, ধসপ্রবণ এলাকাগুলিতে মাস্টার প্ল্যান করা উচিত। ওই এলাকাগুলিতে নির্মাণ কাজ করা হলে, তা যেন মাস্টার প্ল্যানের ভিত্তিতেই করা হয়। তা না হলে এই বিপর্যয় ঠেকানো মুশকিল।
জোশীমঠের বিপর্যয় সামাল দেওয়ার আগেই যে ভাবে মঙ্গলবার কর্ণপ্রয়াগে ফাটল দেখা গিয়েছে, তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তা হলে কি বাকি এলাকাগুলিতেও বিপর্যয় শুধু সময়ের অপেক্ষা? আতঙ্কে ঘুম উড়েছে উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দাদের।
জোশীমঠকে বসবাসের অযোগ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে এই পবিত্রভূমে ঘরবাড়ি ভাঙার কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। প্রথমে ২টি হোটেল ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ‘মাউন্ট ভিউ’ ও ‘মালারি ইন’ নামে ওই ২টি হোটেল পরস্পরের দিকে হেলে রয়েছে। যন্ত্রের সাহায্যে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে হোটেলগুলি।
উত্তরাখণ্ডের ডিজিপি জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত ৬৭৮টি বাড়ি বিপজ্জনক। বহু বাড়ি খালি করে দেওয়া হয়েছে। কিছু বাড়ি খালি করার কাজ চলছে। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ৮ দল, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ১টি দল, পুলিশকর্মীরা রয়েছেন। প্রয়োজনে কিছু এলাকা সিল করে দেওয়া হবে। ওই এলাকার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হচ্ছে।
ভৌগোলিক দিক থেকে জোশীমঠ গুরুত্বপূর্ণ। বদ্রীনাথ, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের মতো একাধিক পর্যটনস্থলের প্রবেশদ্বার এটি। শীতে তুষারপাতের সময় বদ্রীনাথের মূর্তি জোশীমঠেরই নরসিংহ মন্দিরে নামিয়ে আনা হয়। ফলে সনাতন হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে জোশীমঠ। একই সঙ্গে চিনের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে জোশীমঠের দূরত্ব মাত্র ১০০ কিমি। ফলে এই এলাকার গুরুত্ব ধারেভারে অনেকটাই বেশি। শেষ পর্যন্ত এই এলাকা তলিয়ে যাবে কি না, সে নিয়ে একরাশ আতঙ্ক জমেছে জোশীমঠের আকাশে।