হিমাচল প্রদেশের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে আমেরিকার মাটিতে লক্ষ কোটির ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মালিকানা। এ হেন চমকপ্রদ উত্তরণ কি শুধু সিনেমার চিত্রনাট্যেই মানায়? বাস্তবেও যে এমন হতে পারে, তা প্রমাণ করেছেন উদ্যোগপতি জয় চৌধরি।
তাঁর গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুতের আলো পৌঁছত না। নিত্য কাজকর্মের জন্য সর্ব ক্ষণ জলের অভাব ছিল। তবে ছোটবেলা থেকেই নিজেকে প্রথাগত শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন জয়।
আর্থিক বাধাবিপত্তি কাটাতে শিক্ষাই যে অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে, তা অল্প বয়সেই বুঝে গিয়েছিলেন জয়। হিমাচলের উনা জেলার পনোহ গ্রামে পারিবারিক বসতি ছিল জয়দের। বিদ্যুৎহীন সেই গ্রামের বাড়িতে স্কুলের পড়াশোনা সেরেছেন তিনি।
স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে কৃষক পরিবারের জয় পৌঁছেছিলেন বেনারস হিন্দু ইউনির্ভাসিটির ক্যাম্পাসে। সেখানকার আইআইটি থেকে স্নাতকের ডিগ্রিলাভ। তবে এর পর রোজগারের চেষ্টায় নামেননি। বরং উচ্চশিক্ষায় ঝুঁকেছিলেন।
স্নাতকোত্তরে কম্পিউটার ই়ঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন জয়। সে ডিগ্রি পাওয়ার পর বিদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন।
এ বার অবশ্য অন্য বিষয়ে পড়াশোনায় মন দেন। তখন থেকেই কি তাঁর ব্যবসার দিকে ঝোঁক শুরু? বিজ়নেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে আরও এক বার স্নাতকোত্তর ডিগ্রিলাভ করেন জয়।
আমেরিকার সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে এমবিএ ডিগ্রি হাসিল করেছিলেন জয়। উচ্চশিক্ষার নানা স্তরে ভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা তাঁর ব্যবসায়িক জীবনেও কাজে এসেছিল।
আমেরিকার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য বিস্তারের আগে অবশ্য বেশ কিছু দিন সে দেশে চাকরি করেছিলেন এই উদ্যোগপতি। তত দিনে জ্যোতির সঙ্গে সংসার পেতেছেন।
স্ত্রীর সঙ্গে স্টার্টআপ খোলার আগে বেশ কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন জয়।
এনসিআর, আইবিএম, ইউনিসিস থেকে আইকিউ সফ্টঅয়্যার— একের পর এক সংস্থায় কাজের ফলে ম্যানেজার হিসাবে দক্ষতাও বেড়েছিল তাঁর।
১৯৯৭ সালে জ্যোতির সঙ্গে মিলে নিজের প্রথম স্টার্টআপ সংস্থা খোলেন জয়। ‘সিকিয়োরআইটি’ নামে সেই সংস্থার শুরুর আগে দু’জনেই নিজেদের চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন।
বেতনভোগী থেকে ব্যবসার মতো অনিশ্চিত পথে কেন পা বাড়ালেন সস্ত্রীক জয়? কেন ঝুঁকি নিলেন? ২০২১ সালে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র কাছে এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে জয়ের অকপট মন্তব্য, ‘‘হ্যাঁ! বেশ ভালই ঝুঁকি ছিল। আমাদের পরিবারের কারও ব্যবসার অভিজ্ঞতা ছিল না। বাবা ছিলেন ছোটখাটো কৃষক। আর জ্যোতির মা-বাবা বায়ুসেনায় কাজ করতেন।’’
চাকরি ছেড়ে প্রথম স্টার্টআপ খোলার জন্য কী কী করতে হয়েছিল, সে কাহিনিও শুনিয়েছেন জয়। তিনি বলেন, ‘‘আমেরিকায় আমাদের আরামের চাকরি ছিল। তবে আমার পড়তে ভাল লাগে। যা কিছুই পড়ি না কেন, সে বিষয়ের গভীর ডুব দিতেও আগ্রহ জাগে। সে সময় (নব্বইয়ের দশকে) নেটস্কেপ-এর প্রতিষ্ঠাতা মার্ক অ্যান্ডারসনের এমন এক ওয়েব ব্রাউজ়ার নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম, যা তথ্যের মহাসড়কে দুনিয়ার সমস্ত ঘরবাড়িকে এক সুতোয় গেঁথে দেবে।’’
অ্যান্ডারসনের চিন্তাভাবনা মনে ধরেছিল জয়ের। তবে তথ্যের মহাসড়কে নিরাপত্তার অভাব দূর করতে চেয়েছিলেন জয়।
স্ত্রীর সঙ্গে বিস্তর আলোচনার পর ফায়ারওয়াল তৈরির ব্যবসা শুরু করতে অর্থের জোগানে নেমে পড়েন জয় এবং জ্যোতি।
আটলান্টার বেশ কয়েকটি ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট সংস্থায় ঘুরেছিলেন তাঁরা। তবে ওই সংস্থাগুলির পরামর্শ ছিল, আগে নিজের একটি স্টার্টআপ খুলুন। তার পরে বড়সড় ব্যবসায় অর্থ ঢালবেন তাঁরা।
সেই পরামর্শ মেনেই নিজেদের যাবতীয় সঞ্চয় ঢেলে ‘সিকিয়োরআইটি’ শুরু করেন জয়রা। ‘বেলসাউথ’-এর মতো বহুজাতিক টেলিকম সংস্থার কাজ ছেড়ে স্বামীর স্টার্টআপে যোগ দিয়েছিলেন জোকা আইআইএমের ডিগ্রিধারী জ্যোতি।
জয়ের কথায়, ‘‘আমাদের জীবন খুবই সরল, সাধারণ ছিল। বড় কোনও ঋণের বোঝা ছিল না। দামি গাড়ি-বাড়িরও প্রয়োজন ছিল না আমাদের। ফলে স্টার্টআপ শুরু করাটা ছিল পরিকল্পিত ঝুঁকি!’’
আটঘাট বেঁধে ঝুঁকি অবশ্য বার বার নিয়েছেন জয়। ‘সিকিয়োরআইটি’ পরে ‘ভেরিসাইন’-এর কাছে বিক্রি করে ‘সাইফারট্রাস্ট’ গড়েন। সেটিও বিক্রি করেছিলেন ‘সিকিয়োর কম্পিউটিং কর্পোরেশন’-এর কাছে।
এর পর একে একে ‘এয়ারডিফেন্স’, ‘কোরহার্বার’ খুলেছিলেন। সে সংস্থাগুলিও যথাক্রমে ‘মোটোরোলা’ এবং ‘এটিঅ্যান্ডটি’ কিনে নিয়েছিল।
জয়ের সাফল্যের মুকুটে উজ্জ্বল মণি বোধ হয় জ়িস্কেলার। সাইবার জগৎ থেকেই যেটি নিরাপত্তার জোগান দেয়। ২০১৮ সালে এর আইপিও বাজারে ছাড়েন জয়।
এর পর ২০২১ সালে আমেরিকার একটি পত্রিকার বিচারে সে দেশের সবচেয়ে ধনী ভারতীয়দের তালিকায় ন’নম্বর জায়গা দখল করেন। তত দিনে আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছেন তিনি।
অতিমারির সময় ঘরবন্দি বিশ্বের অধিকাংশই যখন বাড়ি থেকে কাজে বসতে বাধ্য হয়েছে, সেই পর্বে ফুলেফেঁপে ওঠে জ়িস্কেলার। ক্লাউড সিকিউরিটি-র দুনিয়ায় অন্যতম জায়গা নিয়ে নেয় এ সংস্থা। ফলে ২০২১ সালে তাঁর নিট সম্পত্তি পৌঁছয় ৭০ হাজার ৯৩২ কোটি টাকায়। সেই সময়ে একটি পত্রিকা দাবি করে, জয় আমেরিকার ধনীতম ভারতীয়।
ওই বছর জয়ের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মূল্যও বিচার করেছিল আমেরিকার পত্রিকাটি। তারা জানিয়েছিল, মোট ১৮ লক্ষ ৫৪ হাজার ৫৮ কোটি টাকার ব্যবসার মালিক জ়িস্কেলারের প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও।