রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব কি দিনে দিনে ‘ভারী’ হয়ে উঠছে ভারতের কাছে? বিশ্ব কূটনৈতিক তথা বাণিজ্য বাজারে ভারত কি ভবিষ্যতে কোণঠাসা হয়ে যাবে? বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এমনই সব সম্ভাবনার প্রশ্ন মাথাচাড়া দিচ্ছে।
কেন আচমকা বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে ভারতের অবস্থা খারাপ হবে? বিশ্বে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে ভারত খুবই ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে এসেছে। বিশ্বের প্রায় সব শক্তিশালী দেশের সঙ্গেই ভারতের ভাল সম্পর্ক।
জি৭ গোষ্ঠীর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায় ভারত। সম্প্রতি ইটালিতে অনুষ্ঠিত জি৭ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে বিভিন্ন নেতার সঙ্গে এক ফ্রেমে ধরা দিয়েছেন তিনি। এমনকি, কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎও সেরেছেন মোদী। সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনাও হয়েছে।
তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পর বিশ্বের প্রায় সব শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রনেতাদের শুভেচ্ছাবার্তা পেয়েছেন মোদী। তাঁদের মধ্যে অনেকে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে যখন ভারতের ‘গুণগান’ করা হয়, তখন কী এমন পরিস্থিতি হল, যা ভবিষ্যতে নয়াদিল্লিকে সমস্যায় ফেলতে পারে? কূটনৈতিক মহলের একাংশের মতে, রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বই বিপদে ফেলতে পারে ভারতকে!
সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, এ বার ভারতের কয়েকটি সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে জাপান। যার ফলে বাণিজ্য ক্ষেত্রে ক্ষতির আশঙ্কা থাকছে ভারতের।
জাপান এবং ভারতের সম্পর্ক আগাগোড়াই ভাল। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয়দের সাহায্য করার ব্যাপারে যে সব বিদেশি শক্তি এগিয়ে এসেছিল, তাদের মধ্যে জাপান অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক কাহিনি লেখা রয়েছে।
স্বাধীনতার পরেও ভারতকে নানা ভাবে, নানা ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জাপান। ভারতীয় বাজারে বহু জাপানি সংস্থা সফল ভাবে ব্যবসা করছে। জাপানেও অনেক ভারতীয় সংস্থা ব্যবসা চালাচ্ছে।
সেই সংস্থাগুলির মধ্যে কয়েকটির উপর এ বার নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে জাপান সরকার। কিন্তু কেন? শোনা যাচ্ছে, রাশিয়ার প্রশাসন এবং রাশিয়ান সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন সংস্থার উপরই নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে আসতে পারে।
সেই ২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে রাশিয়া। দু’বছর অতিক্রান্ত, তবু যুদ্ধ থামার লক্ষণ নেই। অনেক রাষ্ট্রনেতাই যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন, কিন্তু রফাসূত্র এখনও অধরা।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্পষ্ট জানিয়েছেন, তিনি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে সমঝোতার পথে হাঁটতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে কিছু শর্ত মানতে হবে। সেই শর্তের মধ্যে অন্যতম হল, ইউক্রেনকে নেটো সদস্য হওয়ার স্বপ্ন বর্জন করতে হবে।
এ ব্যাপারে যদিও ইউক্রেন কোনও মন্তব্য করেনি। এ দিকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকেই রাশিয়াকে ‘একঘরে’ করে দিয়েছে আমেরিকা-সহ ইউরোপের দেশগুলি। রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশগুলির সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক ভাল। তবে রাশিয়া ইস্যুতে তাদের বিপরীত পথেই হেঁটেছে নয়াদিল্লি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নিন্দা করলেও নয়াদিল্লিকে সে ভাবে মস্কোর বিরুদ্ধে সুর চড়াতে শোনা যায়নি।
রাশিয়ার উপর কোনও রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি ভারত। এমনকি, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সম্প্রতি সুইৎজ়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত শান্তি বৈঠকে ভারত যোগ দিলেও যৌথ বিবৃতিতে সই করেনি। অনেকেই মনে করছেন, রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।
দেশের ৬০ শতাংশ সামরিক সরঞ্জামের জন্য রাশিয়ার উপরে নির্ভরশীল ভারত। রাশিয়া বেঁকে বসলে বিপদে পড়তে পারে ভারত। শুধু সামরিক সরঞ্জাম নয়, তেল, সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও রাশিয়া থেকে আমদানি করে ভারত। এমন অবস্থায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যাওয়া ভারতের পক্ষে কঠিন বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল।
কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে জাপান সব সময়ই রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ করেছে। জারি করেছে নিষেধাজ্ঞাও। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, শুধু রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ক্ষান্ত থাকবে না জাপান। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, এমন দেশের বিভিন্ন সংস্থার দিকে নজর ঘুরিয়েছে জাপান প্রশাসন।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, জাপান সরকারের মুখ্যসচিব ইয়োশিমাসা হায়াশি জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক জি৭ শীর্ষ সম্মেলনে নিষেধাজ্ঞার একটি নতুন নীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে চিন, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং উজ়বেকিস্তানের কিছু সংস্থার উল্লেখ রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
তবে জাপান আনুষ্ঠানিক ভাবে এখনও নিষেধাজ্ঞা জারির ব্যাপারে কিছু বলেনি। জাপান যদি নিষেধাজ্ঞা জারি করেও, তবে তা ভারতের বিরুদ্ধে নয়। শুধুমাত্র কয়েকটি সংস্থার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
ফলে এই নিষেধাজ্ঞা ভারতের সঙ্গে জাপানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনও দাগ ফেলবে না বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল। ভারতের পাশাপাশি চিনের মতো দেশগুলির বিরুদ্ধেও একই পদক্ষেপ করতে পারে জাপান।
যদি নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তবে কি এটাই ভারতের বিরুদ্ধে জাপানের প্রথম এ ধরনের পদক্ষেপ হবে? না। ইতিহাস বলছে, আগেও ভারতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে জাপান।
১৯৯৮ সালে যখন পোখরানে পারমাণবিক পরীক্ষা হয়েছিল, তখন বিশ্বের অনেক দেশই ভারতের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিল। আমেরিকার মতো দেশগুলি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন সেই পথে হেঁটেছিল জাপানও।
প্রায় ২৬ বছর পর সেই পরিস্থিতি তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যার নেপথ্যকারণ বন্ধুত্ব।