লোকে বলে, সাফল্যকে সামলানো সকলের কম্মো নয়! গ্ল্যামার দুনিয়ায় অনেকেই খ্যাতির আলোয় আলোকিত হন। কিন্তু তার পর আচমকাই তাঁদের কাছ থেকে সরে যায় প্রচারের সব আলো। বলিপাড়ার এক সময়ের নামী সঙ্গীত পরিচালক ইসমাইল দরবারের কাহিনিও অনেকটা এ রকমই। রাতারাতি খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সাফল্যের স্বাদ ভোগ করতে না করতেই তাঁকে ধাওয়া করেছিল একের পর এক বিতর্ক। যার জেরে হারিয়ে গিয়েছেন একাধিক জনপ্রিয় গানের এই স্রষ্টা।
ইসমাইলের উত্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। গুজরাতের সুরতে জন্ম তাঁর। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর বাবার ভালবাসা ছিল। সেই সূত্রে ছোট থেকেই গানের পরিবেশ পেয়েছেন ইসমাইল।
গুজরাত থেকে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন ইসমাইল। তার পর বলিউডের অন্যতম প্রথম সারির সঙ্গীত পরিচালক জুটি যতীন-ললিতের দলে বেহালাবাদক হিসাবে কাজ শুরু করেন। এর পর লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি, বাপ্পি লাহিড়ি, আনন্দ-মিলিন্দ, নাদিম-শ্রাবণ, রাজেশ রোশনের মতো নামকরা সঙ্গীত পরিচালকদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পান তিনি।
ভায়োলিন বাদক হিসাবে কাজ করতে গিয়েই ইসমাইলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর। ‘খামোশি’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন যতীন-ললিত। সেই সূত্রেই ভন্সালীর সঙ্গে পরিচয় হয় ইসমাইলের।
ভন্সালীর সঙ্গে ইসমাইলের সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়। এর পর ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে ইসমাইলকে বেছে নেন ভন্সালী। এই ছবির হাত ধরেই রাতারাতি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছন ইসমাইল।
সলমন খান, ঐশ্বর্যা রাই, অজয় দেবগণের এই ছবিতে ‘তড়প তড়প কে ইস দিল’ গানটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এই ছবির হাত ধরেই প্রথম বার জাতীয় পুরস্কার পান ইসমাইল। আস্থা অর্জন করেন ভন্সালীরও।
এই ছবির পর ভন্সালীর পরের ছবি ‘দেবদাস’-এও সুর দেন ইসমাইল। ছবির গানও জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘ডোলা রে ডোলা’ গানটি তুফান তোলে। তবে এর পর থেকেই ভন্সালী এবং ইসমাইলের সম্পর্কে চিড় ধরে।
এর পর আলাদা করে কাজ শুরু করেন ইসমাইল। বেশ কয়েকটি ছবিতে সুর দেন তিনি। কিন্তু সেগুলি ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ কিংবা ‘দেবদাস’-এর গানের মতো জনপ্রিয় হয়নি।
বরং সেই সময় একের পর এক বিতর্ক ঘিরে ধরে ইসমাইলকে। গানের থেকে ব্যক্তিজীবনে বিতর্কের কারণে বেশি প্রচারের আলোয় ছিলেন তিনি।
ফরজ়ানা নামে এক মহিলার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ইসমাইলের। তাঁদের ৪ সন্তান রয়েছে। শোনা গিয়েছিল, প্রীতি সিন্হা নামে এক গায়িকার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। আর এ কারণেই স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
প্রীতিকে পরে ইসমাইল বিয়ে করেছিলেন বলে শোনা গিয়েছিল। প্রীতিকে ধর্মান্তরিত করানো হয় বলেও অভিযোগ। তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল আয়েষা। এ নিয়ে বিতর্ক বেধেছিল। মুম্বইয়ে ইসমাইলের বাড়ির বাইরে কয়েক জন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন ফরজ়ানা। হাতে ছিল ব্যানার। তাতে লেখা ছিল ইসমাইলেরই গানের লাইন, ‘তড়প তড়প কে ইস দিল’।
ফরজানা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর সংসার চালানোর জন্য যে চেক দিয়েছিলেন ইসমাইল, তা বাউন্স করে গিয়েছে। সেই সময় ইসমাইলের ব্যক্তিজীবন চর্চিত হয়েছিল।
ইসমাইলকে ঘিরে বিতর্ক এখানেই থেমে থাকেনি। একটি রিয়্যালিটি শোয়ে বিচারক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে পুনম যাদব নামে এক প্রতিযোগীর সঙ্গে ইসমাইলের সম্পর্ক নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। গরিব পরিবারের মেয়ে পুনম। ওই শোয়ে পুনমের ‘মেন্টর’ বা গুরু ছিলেন ইসমাইল।
পরে অভিযোগ ওঠে যে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন পুনম। সেই সময় পুনমের মা অভিযোগ করেন যে, ইসমাইলই তাঁর কন্যার জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন। ইসমাইলের সঙ্গে পুনমের সম্পর্কের কথাও জানান তিনি। এ-ও অভিযোগ করেন যে, পুনম অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। এ জন্য দায়ী করেন ইসমাইলকেই। তবে পুনম গর্ভপাত করান।
পুনমের মায়ের অভিযোগ ঘিরে হইচই পড়ে গিয়েছিল সেই সময়। যদিও সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন ইসমাইল। বলেছিলেন, বাবার চোখেই দেখেন পুনমকে। পরে পুনমও দাবি করেন যে, তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন না। সবটাই গুজব বলে দাবি করেন।
একটা বিতর্ক শেষ হতে না হতেই আরও একটি বিতর্ক ঘিরে ধরেছিল ইসমাইলকে। ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’ ছবির জন্য অস্কার পেয়েছিলেন সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমান। এ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন ইসমাইল। বলেন, এই পুরস্কার পাননি রহমান, পুরস্কারটি কিনেছেন তিনি।
ইসমাইলের দাবি ভিত্তিহীন বলে সরব হন রহমান। অস্কার কখনও কেনা যায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি। সেই সময় শোনা গিয়েছিল যে, ইসমাইলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করবে অ্যাকাডেমি। পরে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন ইসমাইল। জানান যে, তিনি অস্কারের বিরুদ্ধে নন। ‘বন্ধু’ রহমান যাতে আরও ভাল গান তৈরি করেন, সে জন্যই এ কথা তিনি বলেছিলেন বলে মন্তব্য করেন ইসমাইল।
এই প্রজন্মের অন্যতম জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী অরিজিৎ সিংহকে নিয়েও ইসমাইলের মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। বলেছিলেন যে, অরিজিতের আচরণের সমস্যা (অ্যাটিটিউড) রয়েছে।
এক বিতর্কে জড়িয়ে গ্রেফতার হতে হয়েছিল ইসমাইলকে। তাঁর প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করতেন প্রশান্ত চৌধুরি নামে এক সহকারী পরিচালক। পারিশ্রমিক নিয়ে গোলমাল বেধেছিল। তাঁর অভিযোগ ছিল, কাজ করার পরও পারিশ্রমিক দেননি ইসমাইল।
টাকা নিয়ে গোলমালের জেরে প্রশান্তকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে ইসমাইল, তাঁর পুত্র জায়েদ এবং পুত্রের দুই বন্ধুর বিরুদ্ধে। প্রশান্তের অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তাঁরা জামিনে মুক্ত হন। ইসমাইল নিজেই এক বার বলেছিলেন যে, তাঁর নামের মধ্যেই রয়েছে বিতর্ক। বলেছিলেন, ‘‘বিতর্ক আমার মিডলম্যান।’’ এক সময়ের সেই নামী সঙ্গীত পরিচালকের কেরিয়ারের শুরুটা হয়েছিল খ্যাতি দিয়ে, তার পর যত দিন এগিয়েছে, বিতর্কই হয়ে ওঠে তাঁর নিত্যসঙ্গী।