ইসাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার মিউজিয়াম বস্টন, ম্যাসাচুসেটসের একটি শিল্প জাদুঘর। ১৮৯৮ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে আমেরিকার সংগ্রাহক ইসাবেলা স্টুয়ার্ট এই জাদুঘরটি তৈরি করেন এবং নিজের সংগ্রহে থাকা সমস্ত শিল্পকার্য এই জাদুঘরে রেখে যান। এই জাদুঘরে ইউরোপীয়, এশীয় এবং আমেরিকার শিল্পের বহু নিদর্শন রয়েছে। ১৯৯০ সালে এই জাদুঘরেই ঘটে গিয়েছিল আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিল্পকার্য চুরির ঘটনা।
১৯৯০-এর ১৮ মার্চ, পুলিশের পোশাক পরা দুই ডাকাত মধ্যরাতের পরে ঢুকে পড়ে বস্টনের এই জাদুঘরে। দায়িত্বে থাকা দুই নিরাপত্তারক্ষীকে কাবু করার পর শিল্পী রেমব্রাঁ এবং জোহানেস ভার্মিরের মতো খ্যাতনামী শিল্পীদের অমূল্য সব শিল্পকর্ম দিয়ে চম্পট দেন তাঁরা।
ঘটনার দিন রাতে খ্যাতনামী শিল্পীদের মোট ১৩টি শিল্পকার্য চুরি যায়। এর মধ্যে ১১টি ছবি এবং দু’টি ভাস্কর্য ছিল। এই শিল্পকর্মগুলির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা।
চুরি যাওয়া ছবিগুলির মধ্যে রেমব্রাঁর তিনটি, এডগার ডেগাসের পাঁচটি, ভার্মিরের একটি, এডুয়ার্ড ম্যানের একটি এবং গোভার্ট ফ্লিঙ্কের আঁকা একটি ছবি চুরি গিয়েছিল। ভাস্কর্যগুলির মধ্যে ছিল একটি ব্রোঞ্জের প্রাচীন চিনা পাত্র এবং একটি ফরাসি ‘ইম্পেরিয়াল ইগল’-এর মূর্তি।
এই ঘটনার পর বছরের পর বছর ধরে তদন্তকারীরা এই ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে একাধিক মানুষকে জেরা করেছেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। রহস্যই রয়ে গিয়েছে এই ডাকাতির ঘটনা।
এফবিআইয়ের দাবি, এই ডাকাতির পিছনে ছিল একটি সংগঠিত অপরাধ চক্রের হাত। ডাকাতির পর এই শিল্পকর্মগুলি ফিলাডেলফিয়ায় পাচার করা হয়। এই ডাকাতির ঘটনা চাপা পড়ে যাওয়ার পর ২০০৩ সাল নাগাদ চুরি যাওয়া ছবি এবং ভাস্কর্যগুলি বিক্রি করা হয়৷
ডাকাতির পর তদন্তকারীদের সন্দেহের তালিকায় প্রথম পড়েন মার্লিনো গ্যাং, রবার্ট ‘ববি’ গৌরেন্তে, ববি ডোনাতি, হোয়াইটি বালগার, ডেভিড টার্নারের মতো বস্টনের কুখ্যাত অপরাধীরা। সন্দেহের তালিকায় ছিলেন জাদুঘরের নিরাপত্তারক্ষীরাও।
এফবিআই তদন্ত শুরু করে দেখে, ডাকাতেরা বিশেষ কোনও প্রমাণ ঘটনাস্থলে রেখে যাননি। পাশাপাশি, এফবিআই আধিকারিকরা এই সিদ্ধান্তেও আসতে পারেননি যে, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া আঙুলের ছাপ ডাকাতদের না জাদুঘরের কর্মচারীদের। প্রমাণের অভাব থাকায় এই ডাকাতির ঘটনাকে ‘অনন্য’ বলেও উল্লেখ করে এফবিআই।
তদন্তে নেমে এফবিআইয়ের তরফে বেশ কিছু সন্দেহভাজনের ডিএনএ বিশ্লেষণ করেও কোনও লাভ হয়নি। তবে নিরাপত্তারক্ষী এবং জাদুঘরের কাছে থাকা কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, ঘটনায় যুক্ত দুই ডাকাতের বয়স ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে এবং দু’জনের উচ্চতায় ছ’ফুটের কাছাকাছি। তবে এই তথ্য পেয়েও বিশেষ কোনও লাভ হয়নি এফবিআইয়ের।
প্রমাণের অভাবে এই মামলাটি চাপা পড়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে আবার এই ঘটনা নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে। বেশ কিছু প্রমাণ হাতে আসায় নতুন করে এই ডাকাতির তদন্ত শুরু হয়েছে।
জাদুঘরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অ্যান্টনি আমোর জানিয়েছেন যে, কুখ্যাত অপরাধী জিমি মার্কসের খুনের ঘটনার সঙ্গে এই ডাকাতির যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে। ব্যাঙ্ক ডাকাতি-সহ একাধিক অপরাধের জন্য জেলও খেটেছেন ওই মার্কস।
ডাকাতির ঘটনার ১১ মাস পর ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় বস্টনের শহরতলিতে তার অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খোলার সময় মার্কসকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মার্কস যাতে আততায়ীদের চেহারা না দেখতে পান তার জন্য বাড়ির সামনের বাল্ব্টি নষ্ট করে দেওয়া হয়।
আততায়ীরা মার্কসের মাথার পিছনে দু’বার গুলি করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু কে বা কারা তাঁকে খুন করে তা অমীমাংসিতই থেকে যায়।
নতুন তথ্যে উঠে এসেছে, মৃত্যুর় কয়েক দিন আগে মার্কসকে চুরি যাওয়া ছবিগুলির মধ্যে দু’টি ছবির মালিকানা নিয়ে বড়াই করতে শোনা গিয়েছিল। এর পরই খুন হতে হয় তাঁকে।
মার্কসের সঙ্গে মাফিয়া গৌরেন্তে এহং ডোনাতির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিল বলেও তথ্যে উঠে এসেছে।
মার্কসের ভাগ্নি, ডারলিন ফিনিগান জানান, মৃত্যুর কিছু ক্ষণ আগে মার্কস তাঁকে বলেছিলেন যে, ‘‘বড় কিছু হতে চলেছে এবং আমি নিশ্চিত নই যে আমি এটি করব কিনা।’’ ফিনিগান তখন ভেবেছিলেন যে, তাঁর মামা মাদক বিক্রির কথা বলছেন।
মার্কসের একটি ছবি দেখিয়ে গৌরেন্তের স্ত্রী এলিন তদন্তকারীদেরকে জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বামী মার্কসকে খুন করিয়েছিলেন। এর পর গৌরেন্তের এই ডাকাতির ঘটনায় যোগ থাকার সন্দেহ আরও জোরালো হয়। বর্তমানে গৌরেন্তে এবং তাঁর স্ত্রী দু’জনেই মারা গিয়েছেন।
তবে এত কিছু সত্ত্বেও এখনও এই ডাকাতির ঘটনা অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে। এফবিআইয়ের তরফে ডাকাতদের সন্ধান দিলে প্রথমে ৩৯ কোটি এবং পরে ৭৮ কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও কেউ এগিয়ে এসে কোনও তথ্য দিতে পারেননি।