হিজাবহীন হওয়ার ‘অপরাধে’ আরও এক কিশোরীকে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ উঠল ইরানের নীতিপুলিশের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ১ অক্টোবর তেহরানের একটি মেট্রো স্টেশনে মারধরের সময় তার মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করা হয়। যার জেরে কোমায় চলে যায় সে। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে প্রশাসন।
এই ঘটনায় ইরানের মাটিতে আরও এক মাহসা আমিনি-কাণ্ডের ছায়া দেখছেন সে দেশের মানবাধিকারকর্মীরা। ঠিকমতো হিজাব না পরার অপরাধে গত বছরের সেপ্টেম্বরে যে মাহসাকে পুলিশি হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছিল। যে কাণ্ডের পর ইরানের নানা শহর ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল হিজাব বিরোধী আন্দোলন।
ইরানের সংখ্যালঘু কুর্দিশ সম্প্রদায়ভুক্তদের মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার ‘হেনগো’-র দাবি, ১ অক্টোবর, রবিবার তেহরান মেট্রোর শোহাদা স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার সময় ১৬ বছরের আরমিতা গেরাভান্ডের উপর চড়াও হয়েছিলেন নীতিপুলিশেরা। যার জেরে ট্রেনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অচৈতন্য হয়ে পড়ে সে।
সংবাদমাধ্যমের কাছে ‘হেনগো’ জানিয়েছে, তেহরানে বসবাস করলেও আদতে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে কুর্দ অধ্যুষিত কারমানশাহের বাসিন্দা ছিলেন আরমিতা।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, তেহরানের ফজর হাসপাতালে আরমিতার চিকিৎসা চলছে। অভিযোগ, কিশোরীর মা শাহিন আহমাদিকে ওই হাসপাতালের বাইরে থেকে গ্রেফতার করেছে নীতিপুলিশ। এমনকি, তাঁর পরিবারের সদস্যদের সব ক’টি মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
আরমিতার সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহেও নাকি কড়াকড়ি করছে ইরান প্রশাসন। কোমায় থাকা কিশোরীকে কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া, খবর সংগ্রহের জন্য হাসপাতালে গেলে সোমবার স্থানীয় এক সংবাদপত্রের সাংবাদিককে সাময়িক ভাবে আটক করে পুলিশ।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের কাছে হিজাব বিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেন, ‘‘শাহোদা স্টেশনে আরমিতার উপর হামলা চালিয়েছে প্রশাসন।’’ হিজাব পরার বাধ্যতামূলক নির্দেশ না মানায় নীতিপুলিশদের এই হামলা বলে দাবি তাঁদের। মারধরের জেরে গুরুতর জখম হওয়ায় আরমিতাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে।
আমস্টাডামের রেডিয়ো জ়ামানেহ-এর দাবি, অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, হিজাব না পরায় মেট্রো স্টেশনে কিশোরীকে ধাক্কা মারেন নীতিপুলিশেরা। এর পর তার মাথায় একটি লোহার রড দিয়ে আঘাত করেন।
মঙ্গলবার রাতে নিজেদের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে অচৈতন্য আরমিতার ছবি প্রকাশ করেছেন হেনগো কর্তৃপক্ষ। যদিও ওই ছবির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। ছবিতে দেখা গিয়েছে, মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা এক কিশোরী হাসপাতালের বিছানায় পড়ে রয়েছে। শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য নলের সাহায্য নিতে হচ্ছে তাকে।
আরমিতার উপর হামলার ঘটনায় আদৌ সত্যতা রয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান ইরানের সংবাদ সংস্থা ইরনা। তাদের পাল্টা দাবি, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে একে দুর্ঘটনা বলে মনে হচ্ছে। আরমিতার মা-ও তা মেনে নিয়েছেন।
আরমিতার শারীরিক অবস্থা নিয়ে ইরনার তরফে একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও ওই ভিডিয়োটির একাধিক অংশ সম্পাদিত বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘বিবিসি’। ওই ভিডিয়োয় আরমিতার মা শাহিনকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আমার মনে হয় মেয়ের রক্তচাপ কমে গিয়েছে। তবে আমি সঠিক জানি না।’’
যে মেট্রো স্টেশনের এই হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেই তেহরান মেট্রো কর্তৃপক্ষের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাসুদ দোরোস্তিও মারধরের কথা অস্বীকার করেছেন। আরমিতার সঙ্গে অন্যান্য যাত্রী বা মেট্রোর কর্মীদেরও কোনও ঝামেলা হয়নি বলে দাবি করেছেন তিনি।
ইরনার কাছে মাসুদ বলেন, ‘‘মেট্রোর এজেন্টদের সঙ্গে (আরমিতার) ঝামেলার যে গুজব রটেছে, তা সত্য নয়। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তার প্রমাণ রয়েছে।’’
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছে, মেট্রো স্টেশনে দুই কিশোরীর সঙ্গে ট্রেনের দিকে এগোচ্ছেন হিজাবহীন আরমিতা। ট্রেনে ওঠার মুখে আচমকাই এক কিশোরী সরে আসে। এর পর নিচু হয়ে বসছে। এর পরের ফুটেজে দেখা গিয়েছে, অচৈতন্য আরমিতাকে ধরাধরি করে প্ল্যাটফর্মে শোয়াচ্ছেন অন্য যাত্রীরা।
এই ফুটেজের বহু অংশ প্রকাশ্যে আনা হয়নি বলে দাবি সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের। তাঁদের দাবি, মেট্রো স্টেশনের প্রবেশপথের ছবি প্রকাশ করেনি প্রশাসন। মহিলা যাত্রীরা হিজাব পরেছেন কি না, সেখানেই তা দেখা হত।
গোটা ঘটনায় মাহসা-কাণ্ডের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছেন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ২২ বছরের কুর্দ তরুণী মাহসার মৃত্যু হয়। ‘যথাযথ ভাবে হিজাব পরেনি’ বলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর পর পুলিশি হেফাজতেই মৃত্যু হয় তাঁর। যদিও পুলিশের দাবি, শীরিরিক সমস্যা থাকায় হাসপাতালে মারা যান মাহসা।
নীতিপুলিশের অত্যাচারেই মাহসার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। প্রাক্তন ধর্মগুরু আয়াতুল্লা খোমেইনি এবং বর্তমান ধর্মগুরু আলি খামেনেইয়ের ফতোয়া উড়িয়ে ইরানের মহিলারা ঘোষণা করেন, দেশ জুড়ে হিজাব পরার বাধ্যতামূলক নিয়ম তাঁরা মানেন না।
এর পর তেহরানের নানা প্রান্তে চুল কেটে, আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবাদ মিছিল হয়। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ইসফাহান, মাশাদ-সহ ইরানের অন্যান্য শহরেও। ধীরে ধীরে সে আন্দোলনের ঢেউ ওঠে বিশ্বের নানা প্রান্তে। আন্দোলনকারীদের উপর নীতিপুলিশের দমনপীড়নের অভিযোগও উঠেছে। যার জেরে বহু জনের মৃত্যু হয়েছে।
যদিও সে আন্দোলন থিতিয়ে পড়েছে। তবে হিজাব নিয়ে আরও কড়া আইন করার পথে এগিয়েছে ইরান সরকার। ইসলামিক দণ্ডবিধির ৩৬৮ ধারায় অর্থাৎ হিজাব আইনে আগে ১০ দিন থেকে দু’মাস পর্যন্ত জেল-সহ ভারতীয় মুদ্রায় ৯৭ থেকে ৯৭৭ টাকা জরিমানা হত। সেই মেয়াদ বৃদ্ধি করে ৫ থেকে ১০ বছর করার বিল এনেছে সরকার। সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রায় সর্বোচ্চ ৭ লক্ষ টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে।
আরমিতা-কাণ্ডের প্রতিবাদে আবার আন্দোলনের পথে নামবেন হিজাব বিরোধীরা? মাহসার মতো আরমিতারও কি একই করুণ পরিণতি হবে? প্রশ্ন উঠছে।