ইজ়রায়েলকে রুখতে নিজেদের পরমাণু নীতিতে বদল আনার কথা ভাবছে ইরান। সে ক্ষেত্রে নিজেদের চিরাচরিত ‘অনাক্রমণ’ নীতি থেকে সরে আসতেও পিছপা হবে না তারা।
বৃহস্পতিবার ইরানের পরমাণু নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক আহমেদ হাঘতালব সে দেশের আধা সরকারি সংবাদমাধ্যম তাসনিম নিউজ়কে জানান, ইজ়রায়েল তাদের পরমাণু কেন্দ্র এবং পরমাণু পরিকাঠামোগুলি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালালে তারাও পরমাণু সংক্রান্ত নীতি পুনর্বিবেচনা করে দেখবে।
ইরানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক স্তর থেকে এখনই কোনও উচ্চবাচ্য করা না হলেও মনে করা হচ্ছে, ইজ়রায়েলকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখতে চলেছে তেহরান। ইরানের বক্তব্য, তাদের খুব ভাল করেই জানা রয়েছে, ইজ়রায়েলের কোথায় কোথায় পরমাণু কেন্দ্র রয়েছে। প্রয়োজনে সেগুলি লক্ষ্য করেই আক্রমণ চালানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটি।
ইরান পরমাণু শক্তিধর দেশ। তবে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলে। এই নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে শিয়াপ্রধান ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় শাসক আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের।
ইরানের রক্ষণশীল শাসক খামেনেই বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে রীতিমতো ফতোয়া দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে তিনি ইসলামি ধর্মগ্রন্থ উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, “পরমাণু বোমা তৈরি এবং মজুত রাখা অন্যায়।”
একই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের পরমাণু প্রযুক্তি রয়েছে। তবে ইরান সর্বদা তা এড়িয়ে চলবে।” যদিও ভূরাজনৈতিক কারণে খামেনেইয়ের এই অবস্থান থেকে পরে অনেকটাই সরে আসে ইরান।
২০২১ সালে ইরানের গোয়েন্দা দফতরের তৎকালীন মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পশ্চিমি শক্তিগুলির চাপেই তাঁরা পরমাণু অস্ত্র জোগাড়ে বাধ্য হয়েছেন। অন্য দিকে, ইজ়রায়েল কখনওই সরকারি ভাবে স্বীকার করে না যে, তাদের পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, ইহুদিপ্রধান এই রাষ্ট্রটিও পরমাণু শক্তিধর।
গত শনিবার (১৩ এপ্রিল) মধ্যরাতে ইজ়রায়েলে প্রায় ২০০টি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান সেনা। যদিও আমেরিকা এবং জর্ডনের মতো দেশের সহায়তায় শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থার সাহায্য প্রায় ৯৯ শতাংশ ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রকে প্রতিহত করে ইজ়রায়েল।
ইরানের সেনাবাহিনীর যে আধিকারিক ইজ়রায়েলে হামলা চালানোর দায়িত্বে ছিলেন, তিনি সম্প্রতি দাবি করেন যে, ইজ়রায়েলে যাতে ক্ষয়ক্ষতি বেশি না হয়, সে কারণেই তাঁরা পুরনো অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন।
তবে গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপুঞ্জে ইরানের বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমির আবদোল্লাইয়ান হুঁশিয়ারির সুরে জানিয়ে দেন, ইজ়রায়েল তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে সার্বভৌমত্বের নীতি লঙ্ঘন করলে তারাও উপযুক্ত জবাব দেবে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি দাবি করেন, ইজ়রায়েল হামলা করলে তার প্রত্যাঘাত হবে অত্যন্ত ভয়ানক। যদিও আমেরিকা, রাশিয়া-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইজ়রায়েলকে হামলা না করার অনুরোধই করে আসছে বরাবর।
যদিও সেই অনুরোধ কার্যত উড়িয়েই ইরানকে ‘জবাব দেওয়ার’ সিদ্ধান্তে অবিচল থাকার কথা জানায় তেল আভিভ। ইরানি হামলার পর সপ্তাহ ঘোরার আগেই শুক্রবার সেই ‘জবাব’ দিল ইজ়রায়েল।
শুক্রবার ভোরে তারা ইরানের ‘নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু’তে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজ় এই খবর জানিয়েছে। ইরানের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ইসফাহানে বিস্ফোরণের খবর দেওয়া হয়েছে। সেখানে একটি বিমানবন্দরও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নিশানা হয়েছে বলে পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির খবর।
ঘটনাচক্রে, ইসফাহান এলাকাতেই রয়েছে নাতাঞ্জ-সহ ইরানের কয়েকটি পরমাণু গবেষণা এবং ইউরেনিয়াম পরিশোধন কেন্দ্র। ইরান সরকার ইজ়রায়েলি হামলার কথা স্বীকার করে কয়েকটি ড্রোনকে গুলি করে ধ্বংস করার দাবি করেছে।
এই পরিস্থিতিতে পরমাণু শক্তিধর ইরান আর আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার সমর্থনপুষ্ট ইজ়রায়েলের সংঘাত পশ্চিম এশিয়ায় নয়া বিপর্যয় ডেকে আনবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৭ অক্টোবর গাজ়ায় সংঘর্ষ শুরুর পর থেকেই ধারাবাহিক ভাবে হামাস, হিজ়বুল্লা, হুথি-সহ ইজ়রায়েল-বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ইরানের বিরুদ্ধে। তারই জেরে গত এক মাসে ইরানের বিভিন্ন ঠিকানায় হামলা চালায় বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বাহিনী।