তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন এই মোবাইল ফোন। আজ তিনি নিজেই নিজের সৃষ্টি নিয়ে বীতশ্রদ্ধ। হতাশ। লোকজন যে এই জাল থেকে বার হতেই পারবেন না, এমনটা ভাবেননি মার্টিন কুপার। মোবাইলের জনক। তাই এখন বেশ আক্ষেপ হয় তাঁর। যদিও তিনি মনে করেন, আবিষ্কার এখানেই থেমে থাকবে না। যোগাযোগের জন্য তৈরি হবে আরও উন্নত মানের যন্ত্র, যা হাতে ধরতে হবে না।
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে নিজের হতাশা তুলে ধরেছেন মোবাইলের স্রষ্টা কুপার। তিনি বলেন, ‘‘লোকজন এ ভাবে সারা দিন ফোনের দিকে তাকিয়ে। এমন হবে ভাবিনি!’’ তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রতি লোকজনের এতটা মোহ তাঁকে আনন্দ দেয় না। বরং ভাবায়। কষ্ট দেয়।
এই কুপারই ১৯৭৩ সালে তৈরি করেছিলেন দুনিয়ার প্রথম মোবাইল। সেই পথ কিন্তু সহজ ছিল না। ইহুদি উদ্বাস্তু পরিবারে জন্ম হয়েছিল কুপারের। বাবা-মা ইউক্রেন থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন। শিকাগোতে জন্ম হয়েছিল কুপারের।
ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ১৯৫০ সাল নাগাদ স্নাতক হন কুপার। কোরিয়ান যুদ্ধের সময় ডুবোজাহাজে অফিসার হিসাবে কাজ করেছিলেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে হয়েছিল সেই যুদ্ধ। দক্ষিণ কোরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল আমেরিকা।
১৯৫৭ সালে ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকেই স্নাতকোত্তর যোগ্যতা লাভ করেন কুপার। । ২০০৪ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ই সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি দেয় তাঁকে। স্নাতকোত্তর পড়ার আগেই প্রযুক্তি সংস্থায় যোগ দেন তিনি।
ওই সংস্থায় কাজ করার সময় শিকাগো পুলিশের জন্য বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেন কুপার। পুলিশ রেডিও যন্ত্র। হাতে ধরা যন্ত্রের মাধ্যমেই পুলিশকর্মীরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। এর ফলে দুষ্কৃতী ধরা অনেক সহজ হয় পুলিশের পক্ষে। সত্তরের দশকের শুরুতেই প্রযুক্তি সংস্থার যোগাযোগ সিস্টেম বিভাগের প্রধান হন তিনি। তার পরেই হাত দেন মোবাইল তৈরির কাজে।
সেই মোবাইলের জনক কুপার সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ার ডেল মারেতে নিজের দফতরে বসে একটি সংবাদ সংস্থাকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন, ‘‘মন ভেঙে যায়, যখন দেখি কেউ মোবাইল ফোন দেখতে দেখতে রাস্তা পার হচ্ছেন। কিছু মানুষ মারা না গেলে কারও বোধ আসবে না।’’
কিছু মানুষ মারা গিয়েছেন। তবু বোধ এসেছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। যদিও কুপার মনে করেন, এই মোহও কেটে যাবে। বাজারে আসবে আরও আধুনিক যোগাযোগের যন্ত্র। কী রকম হতে পারে সেই যন্ত্র, তার একটি আঁচ দিয়েছিলেন পুরনো এক সাক্ষাৎকারে।
কুপার মনে করেন, মোবাইল তখন আর আয়তাকার বাক্স থাকবে না। বরং আমাদের কানের চামড়ার নীচে বসানো থাকবে যোগাযোগের সেই যন্ত্র। হাতে আর ধরতে হবে না।
কী ভাবে চার্জ দেওয়া হবে আধুনিক সেই মোবাইল? তা-ও বাতলেছিলেন কুপার। তাঁর মতে, আমাদের শরীর থেকে চার্জ সংগ্রহ করবে সে। তাঁর কথায়, ‘‘আপনার শরীরই হল চার্জার। আপনি যখন খাবার খান, আপনার শরীর এনার্জি তৈরি করে।’’ সেই এনার্জিই হবে মোবাইলের শক্তির উৎস। এমনটাই মনে করেন কুপার।
তবে কুপার আশ্বাস দিয়েছেন, এই ধরনের মোবাইল যন্ত্রের চার্জের জন্য শরীরের খুব বেশি শক্তিক্ষয় হবে না। সামান্য এনার্জিই নিজের জন্য সংগ্রহ করে নেবে সেই আধুনিক মোবাইল। মোবাইল ছাড়াও ভবিষ্যতে শরীরেই বসানো থাকবে কিছু সেন্সর।
ইতিমধ্যেই বেশ কিছু প্রযুক্তি সংস্থা মস্তিষ্কের সঙ্গে কম্পিউটারের সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা করছেন। তার মধ্যে রয়েছে ইলন মাস্কের সংস্থা নিউরালিঙ্ক। খুব শীঘ্রই হয়তো কুপারের ভাবনা নিয়েও গবেষণা শুরু হতে পারে।
যদিও কুপার মনে করেন সাম্প্রতিক কালে মোবাইলের আধুনিকীকরণের জন্য তেমন কোনও চেষ্টা হয়নি। তাঁর মতে, মানুষের মাথার আকৃতি গোলাকার। মোবাইল যন্ত্রটি মসৃণ তলবিশিষ্ট আয়তাকার। যখন কানে ধরা হয়, তখন বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। কুপারের প্রশ্ন, গ্রাহকদের সুবিধা নিয়ে কেন কোনও ভাবনাচিন্তা হচ্ছে না।
এক সময় গ্রাহকদের কথা ভেবেই মোবাইল তৈরি করেছিলেন কুপার। সময়টা ১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল। সেই ফোন ছিল বেশ ভারী, বড়সড় জটিল বস্তু। সে সময়ে তিনি একটি মোবাইল প্রস্তুতকারক সংস্থায় কাজ করতেন।
ওই সময় মোবাইল তৈরি নিয়ে বাজারে দারুণ প্রতিযোগিতা ছিল। কারণ এই মোবাইল তৈরির ভাবনা মানুষের মাথায় এসেছিল অনেক আগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই।
১৯৬০-এর দশকে গাড়িতে ফোন রাখার ব্যবস্থা করে একটি সংস্থা। কিন্তু তা খুব একটা সফল হয়নি। গাড়িতে বিশাল ব্যাটারি রাখতে হত। এর ফলে সমস্যা বাড়ছিল।
কুপারের মনে হয়েছিল, লোকজনের সঙ্গে সব সময় তাদের নিজস্ব ফোন থাকছে না। ১৯৭২ সালের শেষে কুপার ঠিক করেন, তিনি এমন একটি যন্ত্র তৈরি করবেন, যা সব সময় সঙ্গে রাখা যাবে। যে কোনও জায়গায় ব্যবহার করা যাবে। টানা তিন মাস গবেষণা পর, ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসের শেষে সফল হন কুপাররা। কুপারের তৈরি করা প্রথম মোবাইল ফোনটির ওজন ছিল ১ কিলোগ্রামেরও বেশি। সর্বোচ্চ ২৫ মিনিট কথা বলা যেত।
সেই ২৫ মিনিট সময় হাতে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার দফতরে ফোন করেছিলেন কুপার। বলেছিলেন, ‘‘আমি মার্টিন কুপার বলছি। আমি একটা হাতেধরা ফোনে কথা বলছি। একটা সেলফোন, ব্যক্তিগত, এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যায়, হাতে ধরা যায়।’’ এখন সেই ফোন নিয়েই আক্ষেপের সুর প্রবীণের গলায়। ভাবতেও পারেননি, সেই সাধের যন্ত্র এতটা ক্ষতি করবে মানুষের।