মেক্সিকো এবং ইকুয়েডর— গত কয়েক দিনে এই দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমশ অবনতি ঘটছে। সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হতে চলেছে দুই দেশের মধ্যে। এত বছরের সম্পর্ক কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছেন এক জন। তিনি ইকুয়েডরের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ গ্লাস।
দুর্নীতির সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল জর্জের। আর্থিক দুর্নীতি মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ইকুয়েডরের এক আদালত। এক বার নয়, দুই পৃথক মামলায় দু’বার তাঁকে কাঠগড়ায় তোলে তারা। জেলেও যেতে হয় জর্জকে। ২০২২ সালে এক আদালত তাঁর জামিন মঞ্জুর করে। জর্জের অভিযোগ, জামিনে থাকলেও তাঁকে নানা ভাবে হেনস্থা করা হত।
গত বছর ডিসেম্বরে ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটোতে অবস্থিত মেক্সিকান দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় চান জর্জ। তার পর থেকে মেক্সিকান দূতাবাসই ছিল তাঁর ঠিকানা। গত ৫ এপ্রিল ইকুয়েডর পুলিশ জোর করে প্রবেশ করে ওই দূতাবাসে। সেখান থেকেই জর্জকে টেনেহিঁচড়ে বার করে এনে গ্রেফতার করে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু’দেশের সম্পর্কে চিড় ধরে। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ় ওব্রাডর দূতাবাসে পুলিশের অনুপ্রবেশ এবং সেখান থেকে গ্রেফতারের ঘটনাকে ‘স্বৈরাচারী’ কাজ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর অভিযোগ, ইকুয়েডর প্রশাসন আন্তর্জাতিক আইন এবং মেক্সিকোর সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে।
ব্রাজিল-সহ লাতিন আমেরিকার দেশগুলির থেকে সমর্থন পেতে তৎপর হতে দেখা যায় আন্দ্রেসকে। তাঁর আবেদনে সাড়া দেয় বেশ কয়েকটি দেশ। কুইটোর পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক নিয়মের ‘স্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা করেছে তারা। তাদের কথায়, জর্জের গ্রেফতারির নেপথ্যে যৌক্তিকতা যাই থাক না কেন, এমন পদক্ষেপ একেবারেই সমীচীন নয়।
মেক্সিকাল প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, ইকুয়েডরের সঙ্গে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। মেক্সিকোর বিদেশমন্ত্রী মার্সেলো এব্রার্ডেকে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
জর্জের গ্রেফতারি নিয়ে দিন কয়েক ধরেই দু’দেশের মধ্যে চাপানউতর চলছে। শুক্রবার মেক্সিকোর বিদেশ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, তারা জর্জকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল। ইকুয়েডরকে বলা হয়েছিল যাতে জর্জ নিরাপদে দেশের বাইরে যেতে পারেন তার ব্যবস্থা করার জন্য। কিন্তু ইকুয়েডর সে কথায় পাত্তা দেয়নি। শুক্রবার রাতে জোর করে মেক্সিকান দূতাবাসে ঢুকে পড়ে ইকুয়েডরের সশস্ত্র পুলিশবাহিনী। গ্রেফতার করে জর্জকে।
শুক্রবার ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে জোড়া বিবৃতি জারি করা হয়। কুইটোর মেক্সিকান দূতাবাসে পুলিশি অভিযানের আগে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ইকুয়েডর কোনও অপরাধীকে মুক্ত থাকতে দেবে না। পরের বিবৃতিতে জর্জের গ্রেফতারির কথা জানানো হয়।
কে এই জর্জ? ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা জর্জ কয়েক মাস ইকুয়েডরের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলেছেন। এ ছাড়াও তিনি অতীতে টেলি-যোগাযোগ মন্ত্রকের মন্ত্রীও ছিলেন। প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনের শাসনকালে জর্জ খুব কম সময়ের জন্য ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
২০১৭ সালে জর্জের বিরুদ্ধে এক কোটি ৩৫ লক্ষ ডলার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। জর্জকে ছ’বছরের কারাদণ্ডের সাজা শোনায় আদালত।
২০২০ সালে অন্য একটি মামলায় জর্জের বিরুদ্ধে ফের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। সেই মামলায় একা তিনি নন, তাঁর সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়ারও। প্রায় ৮০ লক্ষ ডলার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে দু’জনকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। এই মামলায় দু’জনেরই আট বছরের কারাদণ্ড হয়। তবে জর্জ এবং রাফায়েল উভয়েরই দাবি ছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাঁদের ফাঁসানো হয়েছে।
২০২২ সালে জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন জর্জ। তবে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত তখনও চলছিল। গত ১৭ ডিসেম্বরে জর্জ মেক্সিকোর কাছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। তাঁর আবেদনে সাড়া দেয় মেক্সিকান প্রশাসন। সেই থেকে কুইটোর মেক্সিকান দূতাবাসে থাকতে শুরু করেন জর্জ।
জর্জের গ্রেফতারিতে দু’দেশের সম্পর্ক খারাপ হলেও অতীতে এমন ছবি ছিল না। সেই ১৮৩০ সাল থেকে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল। যা ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে এসে ছিন্ন হওয়ার পথে। ১৯৩৭ সালে ইকুয়েডরের গুয়াকিলে মেক্সিকো একটি কনস্যুলেট খোলে। দু’দেশের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সব সময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
২০১৮ সালে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন আন্দ্রেস। তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন ইকুয়েডরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোরেনা। ২০২১ সালে ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট গুইলারমো ল্যাসো মেক্সিকো সফরে আসেন তখন মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেসের সঙ্গে গোপন বৈঠকও করেছিলেন।
মেক্সিকো এবং ইকুয়েডরের মধ্যে একাধিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। সেই তালিকায় আছে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি, মাদক পাচার মোকাবিলায় সহযোগিতা চুক্তি, পর্যটন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা চুক্তি, বিমান পরিবহণ চুক্তি, ফৌজদারি বিষয়ে আইনি সহায়তা চুক্তি ইত্যাদি। তবে বর্তমানে দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির জেরে সেই সব চুক্তির ভবিষ্যৎও অন্ধকারে।