মাদক সম্রাট পাবলো এস্কোবার। বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং নৃশংস অপরাধী বলেই পরিচিত। কলম্বিয়ার বাসিন্দা হলেও তিনি আমেরিকারও মাথাব্যথার কারণ ছিলেন।
মাদক পাচার করে বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার পাশাপাশি তাঁর নৃশংসতার শিকার হয়েছিলেন বিচারক, সাংবাদিক, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, এমনকি নিজের দলের লোকেরাও।
আশির দশকে কলম্বিয়ায় প্রচলিত ছিল, ‘‘তুমি যতই ক্ষমতাশালী ও গুরুত্বপূর্ণ হও না কেন, যদি এস্কোবার তোমাকে খুন করতে চায়, তবে কেউ তোমায় বাঁচাতে পারবে না।’’
কুখ্যাত এই মাদক সম্রাটের নৃশংসতার চরম নিদর্শন হল ১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে হামলা। এই হামলায় ১১ জন বিচারক নিহত হয়েছিলেন।
এ ছাড়া তাঁর নৃশংসতার আরও এক নির্দশন হল প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে হত্যার জন্য একটি যাত্রিবাহী বিমানে বিস্ফোরণ ঘটানো। যে বিস্ফোরণে মারা যান বিমানের ১১০ জন যাত্রী। ঘটনাচক্রে, ওই বিমানে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন না।
তবে তাঁর একটি অন্য রূপও ছিল। কলম্বিয়ার মেডেলিনে গরীব আদিবাসীদের কাছে তিনি ছিলেন দেবতার মতো। তাঁদের জন্য এস্কোবার স্কুল, পার্ক , হাসপাতাল, স্টেডিয়াম, চার্চ এবং আবাসন তৈরিতে কয়েক লক্ষ অর্থ খরচ করেছিলেন।
১৯৭৬ সালে প্রেমিকা মারিয়া ভিক্টোরিয়া হেনাকে বিয়ে করেন। সেই সময় এস্কোবারের বয়স ২১ এবং মারিয়া ১৫। তাঁদের সম্পর্ক পরিবার মেনে না নেওয়ায় দু’জনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন।
তাঁদের দুই সন্তানও হয়। ছেলের নাম রাখেন হুয়ান পাবলো এবং মেয়ে ম্যানুয়েলা।
এ হেন নৃশংস মানুষটি আদ্যোপান্ত ‘ফ্যামিলি ম্যান’ ছিলেন। পরিবারের কথা ভেবে নিজে কখনও মাদক নেননি।
এক বার পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য পরিবার নিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেন। সেখানে তখন খুব শীত। কোলে বসা ছোট্ট মেয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।
দুই ব্যাগের মধ্যে থাকা প্রায় কুড়ি লক্ষ ডলার পুড়িয়ে দেন মেয়েকে শীতের হাত থেকে বাঁচাতে। পরিবার ছেড়ে থাকতে ভয় পেতেন এস্কোবার।
আর ভয় পেতেন আমেরিকার জেলে থাকতে। তাঁকে প্রত্যর্পণের জন্য আমেরিকার সঙ্গে একটি চুক্তি হয় কলম্বিয়ার।
নিজেকে বাঁচাতে তিনি কলম্বিয়া সরকারকে প্রস্তাব দেন, ১০০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ তিনি মিটিয়ে দেবেন।
আমেরিকার হাতে তুলে না দেওয়া এবং অপরাধমূলক কাজকর্ম কমিয়ে আনার শর্তে তিনি আত্মসমর্পণেও রাজি হন।
তবে তার পরও তাঁর একটি শর্ত ছিল। সেই শর্তানুযায়ী, আত্মসমর্পণের পর তিনি সরকারি জেলে থাকবেন না। নিজের তৈরি জেলে থাকবেন।
সেই জেলে তাঁর নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী থাকবে। জেলের আশপাশে দু’মাইলের মধ্যে কোনও সরকারি নিরপত্তারক্ষী থাকবে না।
প্রশাসন তাঁর শর্ত মেনে নেয়। এস্কোবার তাঁর নিজের তৈরি জেলে থাকতে শুরু করেন।
নিজের বানানো জেলটির নাম হল ‘লা ক্যাথেড্রাল’। কী ছিল না সেই বিলাসবহুল জেলে! জিমনেশিয়াম, স্পা, সুইমিং পুল, হেলিপ্যাড, ফুটবল মাঠ-সহ নানা কিছু।
পাঁচ বছরের জন্য তিনি সেই জেলে থাকতে রাজি হন।
জেলের অদূরেই ছিল এস্কোবারের মেয়ের বাড়ি। তিনি যাতে জেল থেকে মেয়ের বাড়ি দেখতে পান, তার জন্য একটি টেলিস্কোপ লাগানো ছিল।
তবে জেলে থেকে তাঁর অপরাধমূলক কাজকর্ম কমেনি। সব কিছুই চলছিল আগের মতো। জেলের মধ্যে নিয়মিত যৌনকর্মী এবং দামি দামি খাবার আনা হত।
এ সব সত্ত্বেও তৎকালীন কলম্বিয়ান সরকার কর্যত অন্ধের মতো বসে ছিল। কিন্তু তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, যখন এস্কোবার জেলের মধ্যে তাঁর চার সহযোগীকে খুন করেন।
১৯৯২ সালে কলম্বিয়ান বাহিনী জেলটি ঘিরে ফেলে এবং তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে বলে।
নয় জন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি পিছনের একটি সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে যান।
লা ক্যাথেড্রাল থেকে পালানোর পর তাঁকে ধরার জন্য বিশেষ দল গঠন করা হয়। সেই দলের নাম দেওয়া হয় ‘সার্চ ব্লক’।
১৬ মাস পর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায় মেডেলিনের একটি মধ্যবিত্ত কলোনিতে। 'সার্চ ব্লক-এর আনাগোনা টের পেতেই তিনি ছাদ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন।
পালানোর সময় পুলিশ গুলি চালায়। তবে পুলিশ গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, না কি ধরা পড়ার ভয়ে এস্কোবার আত্মহত্যা করেছেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে গিয়েছে।