শৈল্পিক প্রকাশের সর্বোচ্চ রূপ হিসেবে নগ্নতাকে ধরা হয়। যদিও শিল্পে নগ্নতা এবং তার সমালোচনা এসেছে হাত ধরাধরি করে। তা সে ফিদা হুসেনের নগ্ন সরস্বতী হোক কিংবা হালে রণবীর সিংহের নগ্ন ফটোশ্যুট। তবে শত বিতর্কের মাঝে এ দেশেই ৫০ বছর ধরে বসে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম তথা দেশের উচ্চতম নগ্ন শিল্পকর্ম— যক্ষী।
কেরলের মালমপুঝা উদ্যানে বসে আছে এই নগ্ন মহিলা মূর্তি। ৩০ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্যের নাম যক্ষী। শিল্পীর নাম কানায়ি কুনিরামণ। ১৯৬৯ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে এই শিল্পের স্রষ্টার বয়স এখন ৮৫ বছর। বার্ধক্যে পৌঁছে নিজের শিল্পকে ‘অমরত্ব’ দিতে চান তিনি। তাই আবার মজেছেন শিল্পকর্মে।
মূর্তি তৈরির পর পার হয়েছে ৫৩ বছর। এখন কুনিরামণ চান পুরো মূর্তিটিকে ব্রোঞ্জের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দিতে। ভবিষ্যতে যাতে কোনও প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা তাঁর এই শিল্পকর্মকে নষ্ট করতে না পারে।
নগ্ন শরীর। উদ্ধত স্তন। দু’টি পা দু’দিকে ছড়ানো, হাত দু’টি উপরে তোলা। চোখ দু’টি বন্ধ। ৩০ ফুট উচ্চতার এই নগ্ন মূর্তি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। বিশেষত, শিল্পবোদ্ধা এবং ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে। এই ভাস্কর্যেরই সংস্কারে নামছেন বৃদ্ধ ভাস্কর।এই নগ্ন ভাস্কর্যের মাধ্যমে শ্বাশ্বত সৃজনশীলতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন ভাস্কর। তবে এই মূর্তি নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। এমনকি, নগ্ন মূর্তিটি সরানোর চেষ্টাও হয়েছিল।
তখন সদ্য লন্ডন থেকে ফিরেছেন কুনিরামণ। ১৯৬৮ সালে কেরলের সেচ দফতর তাঁকে আহ্বান জানায় মূর্তিটি মালমপুঝা উদ্যানে বসাতে।
যক্ষীমূর্তি তৈরির আগে কুনিরামণের অবশ্য অন্য পরিকল্পনা ছিল। প্রথমে ভেবেছিলেন, কোনও পুরুষ মূর্তি তৈরি করবেন। কিন্তু ওই উদ্যান এবং তার পাশে সুবিশাল পাহাড় দেখে ভাবনায় বদল আনেন শিল্পী।
দু’পাশে পাহাড়। মাঝখানে উদ্যান। এই প্রাকৃতিক দৃশ্যকে এক শুয়ে থাকা রমণীর সঙ্গে কল্পনা করেন কুনিরামণ। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নেন যক্ষীর মূর্তি গড়ার।
শুধু মূর্তির উচ্চতার জন্যই নয়, যক্ষীর ভঙ্গিমা এবং দেহসৌষ্ঠবের জন্য। সেখানেই তাঁর মডেলকে ধন্যবাদ জানান শিল্পী।
কিন্তু এই ভাস্কর্য তৈরির খবর ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় বিতর্ক। কেরলের রাস্তায়-রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল হয়। শিল্পী পেয়েছেন হুমকিও। কিন্তু এ সব বাধা পরোয়া করেননি কুনিরামণ। তিনি তখন সৃষ্টিসুখে মগ্ন।
এখনও নগ্নতা নিয়ে কেন এত বিতর্ক! ভাবেন বৃদ্ধ ভাস্কর। অন্ধকার যুগ কাটিয়ে রেনেসাঁস (নবজাগরণ) নিয়ে এসেছিল আধুনিক এবং সভ্য ইউরোপ। সেই রেনেসাঁ যুগের প্রায় সব শিল্পীর তুলিতে উঠে এসেছে নগ্নতা। এমনকি, সমাজের গোঁড়ামিকে ধাক্কা দিয়ে নগ্ন যিশুও আঁকা হয়েছে।
সময় পেরিয়েছে বিস্তর। প্রচুর আধুনিক শিল্পকর্ম হয়েছে। কিন্তু নগ্নতা নিয়ে ছুঁতমার্গ যায়নি। সেটা ইউরোপ হোক বা এশিয়া। জানান কুনিরামণ।
কুনিরামণ যখন ৩০ ফুট উচ্চতার এই দেবী মূর্তি গড়ছেন, মোট পাঁচ জন মহিলা তাঁকে সাহায্য করেছেন। তাঁরা ছিলেন মডেল। যাঁদের দেখে গড়ে তুলেছেন ৩০ ফুট উচ্চতার নগ্ন মূর্তিকে।
মডেলদের মধ্যে প্রধান ছিলেন নাফিসা। বছর দুই আগে মূর্তির সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন শিল্পী।
বিশ্বের অন্যতম উচ্চ নগ্ন মূর্তি কেরলের যক্ষী। ভারতে মন্দিরের বাইরে সম্ভবত এটাই উচ্চতম নগ্ন ভাস্কর্য। তাই তাঁর কীর্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন কুনিরামণ।
শিল্পী জানান, ব্রোঞ্জ প্লেটিং দিলে কোনও ক্ষয় ছাড়া দীর্ঘ দিন অক্ষত থাকবে এই মূর্তি। কেরল সরকার যে এই মূর্তি সংরক্ষণ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বৃদ্ধ ভাস্কর জানান নগ্নতাকে নিয়ে ছুঁতমার্গ তাঁর বোকামো মনে হয়। তাঁর কথায়, ‘‘মন্দিরে দেওয়াল থেকে মহিলা ভাস্কর্যকে বার করে আনার প্রথম সাহসী প্রয়াস হল এই যক্ষী মূর্তি। এর আগে পর্যন্ত, মহিলা ভাস্কর্য কেবল শোভা পেত মন্দিরের দেওয়ালে।’’
কুনিরামণের সংযুক্তি, ‘‘এই মূর্তির নগ্নতার মধ্যে লেশমাত্র অশ্লীলতা বা অশ্লীলতার ইঙ্গিত নেই। তবে যাঁরা নগ্ন শিল্পকর্মকে অশ্লীল ভাবেন, তাঁরা আসলে মহিলাদের ওই ভাবে কল্পনা করতে অভ্যস্ত।’’