শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু। প্রাচীন এই প্রবাদকে স্মরণে রেখেই পড়শি অথচ শত্রু দেশের বিরুদ্ধে কৌশল সাজাচ্ছে ভারত।
তাইওয়ানের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক বরাবরই ‘মধুর’। স্বশাসিত তাইওয়ানকে চিন নিজেদের অংশ বলেই দাবি করে এসেছে বরাবর।
চিন আর তাইওয়ানের মধ্যে রয়েছে তাইওয়ান প্রণালী। তবে দুই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক ব্যবধান যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে রাজনৈতিক ব্যবধান।
চিনকে জব্দ করতে আমেরিকা বরাবরই তাইওয়ানের স্বশাসনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাইওয়ানকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়নি ওয়াশিংটন।
বেজিং বরাবরই মনে করে, তাইওয়ান আদতে চিনের অংশ। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সরকারের আমলেও সেই নীতিতে অটল রয়েছে তারা। তবে তাইওয়ান সেই দাবি অস্বীকার করে এসেছে।
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে চেয়ারম্যান মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে চিনে সশস্ত্র গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা দখলের পরে জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাইশেক এবং তাঁর অনুগামীরা ঘাঁটি গড়েছিলেন তাইওয়ান দ্বীপপুঞ্জে।
তার পর থেকে মূলত আমেরিকা এবং পশ্চিমি দুনিয়ার আর্থিক ও সামরিক সাহায্যে এখনও টিকে আছে ‘পৃথক’ তাইওয়ান। কিন্তু জিনপিংয়ের জমানায় চিন ক্রমশ আগ্রাসী নীতি অবলম্বন করে তাইওয়ান দখল করতে চাইছে বলে অভিযোগ।
চিন-তাইওয়ান গোলযোগে ভারত এই কিছু দিন আগে পর্যন্তও কোনও পক্ষ নেয়নি। নেহরুর আমল থেকেই ভারত ‘এক এবং অখণ্ড চিন’ নীতিকে সমর্থন করে এসেছে। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের পরেও এই নীতিতে বদল ঘটেনি। এখনও যে ভারত সরাসরি কোনও একটি পক্ষকে সমর্থন করছে, তেমনটাও নয়। তবে চিন ভারতের নাকের ডগায় পাক অধিকৃত কাশ্মীর দিয়ে বাণিজ্যপথ (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ) তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার পরেই তাইওয়ানের সঙ্গে সখ্য বাড়িয়েছে ভারত। বেজিং-তাইপেই দুই পক্ষের ‘মধুর’ সম্পর্ককে নিজেদের বৈদেশিক নীতির কৌশল নির্ধারণেও কাজে লাগাচ্ছে নয়াদিল্লি।
সম্প্রতি ভারতের ‘ইন্ডিয়া-তাইপেই অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘তাইপেই ইকোনমিক অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার’-এর মধ্যে মউ (সমঝোতাপত্র) স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্থির হয়, তাইওয়ানের শ্রমিক সমস্যা মেটাতে ভারতের দক্ষ কর্মপ্রার্থীরা সেখানে কাজের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন।
এ-ও স্থির হয় যে, যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারলে ওই কর্মীদের স্থায়ী করা হবে এবং তাঁদের সুরক্ষার বিষয়টি দেখবে তাইওয়ান সরকার। প্রসঙ্গত, নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতের সঙ্গে তাইওয়ানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্রমোন্নতি হয়েছে।
তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে নয়াদিল্লি তাইওয়ানকে স্বীকৃতি না-দেওয়ায় কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। নয়াদিল্লি বা তাইপেইতে নেই কোনও দূতাবাসও। ‘ইন্ডিয়া-তাইপেই অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘তাইপেই ইকোনমিক অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার’-ই কার্যত দুই জায়গার দূতাবাসের ভূমিকা পালন করে।
গত দু’বছরে একাধিক বার তাইওয়ানের জল এবং আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে বেজিং। প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের অগস্টে চিনের আপত্তি খারিজ করে আমেরিকার কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজ়েনটেটিভসের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পরেই নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়।
চিনের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিল শি জিনপিংয়ের দেশ। তাইওয়ানের মানুষকে নাকি ভোট দিতেই নিষেধ করেছিল বেজিং।
কিন্তু হুঁশিয়ারিই সার। চিনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাইওয়ানে আবার ক্ষমতায় আসেন চিন-বিরোধী শাসক লাই চিং তে। ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি)-র নেতা তিনি।
তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করার ইঙ্গিত দিয়ে সম্প্রতি তাইওয়ানের প্রবীণ নাগরিক ইয়ুং লিউকে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্মভূষণ দিয়েছে ভারত।
ইয়ুং লিউ বিশ্বের সবচেয়ে বড় চুক্তিভিত্তিক বৈদ্যুতিন সামগ্রী প্রস্তুতকারক সংস্থা ফক্সকনের সিইও। সারা বিশ্বে মোট আইফোনের ব্যবসার ৭০ শতাংশে ফক্সকনের হাত রয়েছে।
কোভিড অতিমারির পরবর্তী সময় থেকে সুকৌশলে ফক্সকন চিনে পণ্য উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস করেছে। সেই সঙ্গে ভারতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে এই সংস্থা। গত কয়েক বছরে ভারতে ফক্সকনের উপস্থিতি আলাদা করে চোখে পড়েছে।
ভারত এখনই চিনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পথে না হাঁটতে চাইলেও তাইওয়ানের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে সুসম্পর্ক রেখে চলতে চায়। এর মাধ্যমে বেজিংকেও চাপে রাখতে চায় নয়াদিল্লি।
বর্তমানে প্রায় ৫০০০ ভারতীয় তাইওয়ানের বিভিন্ন সংস্থায় উচ্চপদে কর্মরত। তা ছাড়াও রয়েছেন বিভিন্ন পদে কাজ করা আরও কয়েক হাজার ভারতীয়। তাদের সুরক্ষার বিষয়ে সদাসতর্ক নয়াদিল্লি নিবিড় যোগাযোগ রেখে চলেছে তাইপেই প্রশাসনের সঙ্গেও।
অন্য দিকে, শনিবারও তাইওয়ানের জল এবং আকাশসীমার কাছে নতুন করে যুদ্ধ মহড়া শুরু করল চিনের পিপলস্ লিবারেশন আর্মি। এই পরিস্থিতিতে ভারত চিনের এই ‘বিদ্রোহী’ ভূখণ্ড নিয়ে কী অবস্থান নেয়, সে দিকে নজর থাকবে সকলের।