নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিওয়ান হাউসিং ফিনান্স কর্পোরেশন লিমিটেড (ডিএইচএফএল)-এর প্রোমোটার তথা প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর কপিল ওয়াধওয়ান এবং প্রাক্তন ডিরেক্টর ধীরাজ ওয়াধওয়ানের বিরুদ্ধে নতুন মামলা দায়ের করল সিবিআই।
ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৭টি ব্যাঙ্কের ৩৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা প্রতারণার জন্য ডিএইচএফএল-এর প্রাক্তন কর্তাদের বিরুদ্ধে এই নতুন মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ডিএইচএফএল-এর ব্যাঙ্ক জালিয়াতির পরিমাণ নীরব মোদীর করা জালিয়াতির প্রায় তিনগুণ। এই ব্যাঙ্ক জালিয়াতিকে এখনও পর্যন্ত ভারতের সব থেকে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের একটি অভিযোগের ভিত্তিতে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। তবে কী ভাবে শুরু হল সব থেকে বড় এই ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনা? নেপথ্যেই বা কারা ছিলেন?
২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১৭টি সংস্থা যৌথ ভাবে ৪২ হাজার ৮৭১ কোটি টাকার ঋণ দেয় এই সংস্থাকে। ২০১৯ সালে ডিএইচএফএল-এর বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের অভিযোগ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর এই সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।
এর পর ঋণদাতা ব্যাঙ্কগুলি ২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যৌথ ভাবে একটি বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে ঋণদাতা ব্যাঙ্কগুলি ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর সময়কালে ডিএইচএফএল-এর হিসেবনিকেশ খতিয়ে দেখতে বিশেষ অডিটের সিদ্ধান্ত নেয়। অডিটের জন্য বহুজাতিক অ্যাকাউন্টিং সংস্থা কেএমপিজি-কে নিযুক্ত করে ঋণদাতা ব্যাঙ্কগুলি ৷
পাশাপাশি ব্যাঙ্কগুলি কপিল এবং ধীরাজের উপর ক়ড়া নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা করে৷ অভিযুক্তেরা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে তার জন্য ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর বিশেষ নোটিসও জারি করে। এর পরই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে কেপিএমজি-এর অডিটেও। ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া অভিযোগ করে যে, অডিটে ডিএইচএফএল এবং ওই সংস্থার তৎকালীন কর্তাদের লেনদেনে একাধিক অসঙ্গতি লক্ষ করা গিয়েছে।
অডিটে এই সংস্থার লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে লাল সতর্কতাও জারি করে কেপিএমজি। তাদের দাবি ছিল, ডিএইচএফএল-এ বৈধ লেনদেনের আড়ালে এবং সংস্থার নাম করে একাধিক অবৈধ লেনদেনও হয়েছে। আর এর বেশির ভাগ লেনদেনেই কপিল এবং ধীরাজের যুক্ত থাকার বিষয়টি নিয়েও সতর্কতা জারি করে কেপিএমজি।
কেপিএমজি-এও লক্ষ করে, প্রায় ৬৬টি ভুয়ো সংস্থাকে ২৯ হাজার কোটির বেশি টাকা ঋণ দিয়েছে ডিএইচএফএল। এই সংস্থাগুলির প্রোমোটার বা তাঁদের পরিচিতদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বলেও তদন্তে উঠে আসে। এদের মধ্যে বহু সংস্থার ডিরেক্টর ও অডিটরের নাম, এমনকি ই-মেল আইডি পর্যন্ত এক। অথচ ধার দেওয়া হয়েছে সে সব খতিয়ে না দেখেই।
অভিযোগ ওঠে, ঋণের টাকা পরে দেশের বাইরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে প্রোমোটারদেরই বিভিন্ন সংস্থা ও প্রকল্পে। কেনা হয়েছে বিপুল সম্পত্তি। শ্রীলঙ্কায় একটি ক্রিকেট টিমও কেনা হয়েছে। অন্য একটি পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ডিএইচএফএলকে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে ৩২টি ব্যাঙ্ক। একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে নড়েচড়ে বসে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
এর পর ইয়েস ব্যাঙ্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রানা কপূরের সঙ্গে যোগসাজশ করে একাধিক অবৈধ লেনদেন এবং অর্থ তছরুপের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় কপিল এবং ধীরাজকে। সিবিআই এবং ইডি তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করে। গ্রেফতার করা হয় রানাকেও। তিনি বর্তমানে মুম্বইয়ের তালোজা জেলে বন্দি।
অভিযোগ উঠেছিল তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য রানা অবৈধ ভাবে কপিল এবং ধীরাজকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
গ্রেফতার হওয়ার পরও তদন্ত থামেনি কপিল এবং ধীরাজের বিরুদ্ধে। তদন্ত চলাকালীন কেঁচো খুড়তে বেরিয়ে আসে কেউটে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার আওতায় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিতেও নাম জড়ায় দুই ডিএইচএফএল প্রোমোটার কপিল এবং ধীরজের।
ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে হাজার হাজার কোটি টাকার গৃহঋণ দেখিয়ে ভর্তুকি বাবদ কেন্দ্রের কাছ থেকে তাঁরা প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে কপিল-ধীরাজের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা দুর্নীতিতে তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দায়ের করেছে সিবিআই।
অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া এবং নিম্ন ও মাঝারি আয়ের মানুষের মাথায় পাকা ছাদ গড়ে দিতে ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পটির সূচনা হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় যে দুর্নীতি চলছিল, তার পর্দাফাঁস করে সিবিআই।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ফ্ল্যাট, বাড়ি কেনার জন্য ঋণ দেওয়ার ব্যবসাও রয়েছে ডিএইচএফএল-এর। গোয়েন্দা সূত্রে জানায়, ব্যবসার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই কোটি কোটি টাকা হাতায় ডিএইচএফএল। সরকারি খাতায় দেখা যায়, সরকারি প্রকল্পের আওতায় বহু মানুষ তাদের কাছ থেকে মোট ১৪ হাজার কোটি টাকার গৃহঋণ নিয়েছেন। সেই বাবদ প্রায় এক হাজার ৮৮০ কোটি টাকা ভর্তুকি তাদের প্রাপ্য।
এখনও জেলেই রয়েছেন কপিল-ধীরাজ। তবে তাঁদের দুর্নীতির জট এখনও খুলছে।