প্রতিভার কমতি কখনওই ছিল না ভারতে। সেই প্রাচীন কালে পৃথিবীর অঙ্ক দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলেছিল আর্যভট্ট, বরাহমিহিরদের আবিষ্কার। তার পর থেকে বিজ্ঞানে, শিল্পে, অভিনয়ে, সঙ্গীতে, চিকিৎসা শাস্ত্রে এমনকি, অর্থনীতিতেও বিশ্বের চেনা অঙ্ক বদলে দিয়েছেন ভারতীয়রা। তা হলে বাণিজ্যেই বা পিছিয়ে থাকবে কেন?
দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের তাবড় সংস্থার মাথাতেও বসে আছেন এক এক জন ভারতীয়। তাঁদেরই নেতৃত্বে তরতরিয়ে এগোচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সেরা এবং নামী সব সংস্থা। কারা এঁরা?
আমেরিকার অন্যতম বড় প্রযুক্তি সংস্থা আইবিএমের কথাই ধরা যাক। ১৭৫টি দেশে ব্যবসা করা এই বহুজাতিক সংস্থা যাঁর কথা শুনে কাজ করে, তিনি ভারতের আইআইটি কানপুরের ছাত্র।
নাম অরবিন্দ কৃষ্ণা। বয়স ৬১। গত দু’দশক ধরে আইবিএমের সঙ্গে রয়েছেন তিনি। তাঁর নিষ্ঠা এবং মেধা চিনতে দেরি করেনি আইবিএম। প্রাক্তন সিইও ভার্জিনিয়া রমেটিকে সরিয়ে তাঁকেই বেছে নেয় বহুজাতিক সংস্থা।
গুগ্ল এলএলসি এবং অ্যালফাবেট আইএনসির সিইও-ও এক ভারতীয়। তাঁকে আলাদা করে চেনানোর দরকার নেই। তিনি সুন্দর পিচাই। সাধারণ ম্যানেজমেন্ট এগজিউটিভ হিসাবে গুগ্লে এসেছিলেন খড়্গপুর আইআইটির ছাত্র সুন্দর।
তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ের এই যুবক অচিরেই তাঁর গুণের সুবাদে জায়গা করে নেন শীর্ষ কর্তাদের মনে। ২০০৪ সালে গুগ্লে যোগ দেওয়ার ১৫ বছরের মাথায় ২০১৯ সালে গুগলের মূল সংস্থা অ্যালফাবেটের মাথায় বসানো হয় তাঁকে। তখন পিচাই সবে ৪৭।
সাধারণ তেলুগু পরিবারে জন্ম সত্য নাদেলার। বয়স এখন ৫৬। প্রাথমিক পড়াশোনা হায়দরাবাদের কলেজে। পরে বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে ১৯৯২ সালে মাইক্রোসফটে যোগ দেন নাদেলা। প্রথমে সার্ভার অ্যান্ড টুল বিভাগে কাজ করতে শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে উন্নতি হয়। তাঁর নেতৃত্বে ক্লাউড কম্পিউটিং সংক্রান্ত কাজে যোগ দিয়ে বিপুল এগিয়ে যায় মাইক্রোসফট।
সেই সত্যকেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্ম মাইক্রোসফটের মাথায় বসানো হয় ২০১৪ সালে। তাঁর আগে স্টিভ বালমার ছিলেন মাইক্রোসফটের সিইও। পরে মাইক্রোসফটের এগজিকিউটিভ চেয়ারম্যানও হন তিনি। ২০২১ সালে জন ডব্লু থম্পসন ছিলেন ওই পদে। তাঁকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় সত্যকে।
অ্যাডোব ইনকর্পোরেশেনর সিইও শান্তনু নারায়ণও সত্যের মতোই হায়দরাবাদের সন্তান। অ্যাডোবে যোগ দেওয়ার আগে দীর্ঘদিন অ্যাপলে কাজ করেছেন শান্তনু। শোনা যায়, অ্যাপলেও শান্তনুর কাজ বিপুল সমাদৃত হয়েছিল।
এই শান্তনুকেই নিজেদের সিইও পদে বসায় কম্পিউটার সফটওয়্যারের অন্যতম বিশেষজ্ঞ সংস্থা অ্যাডোব। ১৯৯৮ সালে অ্যাডোবে যোগ দেন শান্তনু। সাত বছরের মাথায় ২০০৫ সালে তাঁকে সিওও পদে বসানো হয়। ২০০৭ সালে আমেরিকান সংস্থাটি তাদের আমেরিকান সিইওকে সরিয়ে তার পদে বসায় শান্তনুকে।
আমদাবাদ আইআইএমের ছাত্র অজয়পাল সিংহ বঙ্গা এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট। তার আগে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পেমেন্ট প্রসেসিং কর্পোরেশেন মাস্টারকার্ড ইনকর্পোরেশেনরেও সিইও এবং এগজিকিউটিভ চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
জলন্ধরের শিখ পরিবারের সন্তান বঙ্গা জন্মেছিলেন পুণেতে। তাঁর বাবা ছিলেন ভারতীয় সেনা অফিসার। শিমলা, দিল্লি, হায়দরাবাদে স্কুল কলেজের পড়াশোনা। অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর আমদাবাদ থেকে এমবিএ করেন। ১৯৮১ সালে কেরিয়ার শুরু নেসলে-তে শিক্ষানবিশ হিসাবে। তবে খুব শীঘ্রই ব্যাঙ্কিং সেক্টরে চলে আসেন। তার পর ক্রমশই উন্নতি হয়েছে বঙ্গার।
আমেরিকার কম্পিউটার নেটওয়ার্কিংয়ের নামী সংস্থা আরিস্টা নেটওয়ার্কের মাথায় রয়েছেন যিনি, তিনি এক ভারতীয় নারী। নাম জয়শ্রী উল্লাল। বয়স ৬২। লন্ডনের হিন্দু পরিবারে জন্ম হলেও জয়শ্রীর স্কুলের পড়াশোনা পুরোটাই দিল্লিতে। পরে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আবার বিদেশে চলে আসেন জয়শ্রী। পরে বিদেশেই কর্মজীবন শুরু করেন।
এই জয়শ্রীকে বিশ্বের নেটওয়ার্কিং জগতের প্রথম পাঁচ সেরা প্রভাবশালীদের একজন বলে উল্লেখ করেছিল ফোর্বস পত্রিকা। পরে ব্যারন এবং ফরচুন নামের বাণিজ্য সংক্রান্ত পত্রিকাও তাঁকে বিশ্বের অন্যতম সেরা সিইও এবং অন্যতম সেরা ব্যবসায়ীর তকমা দেন। এই জয়শ্রীকেই ২০০৮ সালে আরিস্তা তাদের সিইও এবং প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেন।
ব্রিটেনের টেলিকমিউনিকেশন সংস্থা ইনমারস্যাটের সিইও রাজীব সুরি। এর আগে মোবাইল প্রস্তুতকারী ফিনল্যান্ডের সংস্থা নোকিয়ারও সিইও ছিলেন। ২০১৪ সালে তাঁকে নোকিয়ার প্রধান হিসাবে ঘোষণা করে সংস্থাটি। তাঁর আগে নোকিয়ার সিইও পদে যাঁরাই বসতেন তাঁদের জন্মসূত্রে ফিনল্যান্ডের মানুষ হতে হত।
তাঁর আগে একমাত্র কানাডার এক ব্যবসায়ীকে নিজেদের সিইও করেছিল নোকিয়া। তার পরেই রাজীবকে ওই পদ দেওয়া হয়। টানা ছ’বছর ওই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন রাজীব। দিল্লির ছেলে রাজীব ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন মনিপাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে।
জর্জ কুরিয়েনের জন্ম কেরলে। তিনি আবার গুগ্ল ক্লাউডের সিইও টমাস কুরিয়েনের যমজ ভাই। এক সময় হোটেলের দরজায় গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ করতেন। পরে পিৎজা তৈরির রাঁধুনি এবং বারটেন্ডার হিসাবেও কাজ করেছেন। দু’জনেই আইআইটি মাদ্রাজের ছাত্র। পরে স্কলারশিপ পেয়ে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান পড়াশোনা করতে।
২০১৯ সালে টমাস গুগ্ল ক্লাউডের সিইও হন। জর্জকে ২০১৫ সালে সিইও ঘোষণা করা হয় ক্যালিফোর্নিয়া কেন্দ্রিক ডাটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার সংস্থা নেট অ্যাপে।
আমেরিকার বহুজাতিক সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা পালো অল্টো নেটওয়ার্কের সিইও-ও একজন ভারতীয়। নাম নিকেশ আরোরা। বয়স ৫৫।
উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে জন্ম। বাবা এক ভারতীয় বায়ুসেনা অফিসার। বায়ুসেনার স্কুলেই পড়াশোনা। পরে বেনারসের আইআইটি (বিএইচইউ)-এ ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে স্নাতক হন। আরোরা ২০১১-২০১৪ সাল পর্যন্ত গুগলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০১৪ সালে সফট ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট হন। ২০১৮ সালে পালো অল্টোয় সিইও হিসাবে দায়িত্ব নেন নিকেশ।
আমেরিকার বহুজাতিক সংস্থা স্যানডিস্কের সহ প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জয় মেহরোত্রার জন্ম কানপুরে। প্রাথমিক পড়াশোনা দিল্লিতে। পরে অবশ্য স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন। ২০১৭ সালে তাঁকে কম্পিউটার মেমরি প্রস্তুতকারী সংস্থা মাইক্রোন টেকনোলজির সিইও পদে বসানো হয়।
লক্ষ্মণ নরসিংহ এখন আমেরিকার বহুজাতিক কফি সংস্থা স্টারবাকস-এর সিইও। এককালে পেপসিকো-র সিওও এবং রেকিট সংস্থার সিইও হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ৫৬ বছরের লক্ষ্মণের জন্ম মহারাষ্ট্রের পুণের এক হিন্দু পরিবারে। পুণেতেই ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে স্নাতক হয়েছেন। পরে এমবিএ করেন বিদেশে। ২০২২ সালে তাঁকে নিজেদের সিইও হিসাবে ঘোষণা করে স্টারবাকস।
আমেরিকার বহুজাতিক সংস্থা ফ্লেক্সের সিইও পদে রয়েছেন এক ভারতীয় নারী। নাম রেবতী অদ্বৈতী। বয়স ৫৬। জন্ম ভারতে।
রাজস্থানের বিড়লা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সের ছাত্রী। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেবতীকে নিজেদের নতুন সিইও হিসাবে ঘোষণা করে ফ্লেক্স।
ফরাসি ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেলের সিইও-ও একজন ভারতীয় মহিলা। নাম লীনা নায়ার। মহারাষ্ট্রের হিন্দু পরিবারে জন্ম লীনার। বয়স ৫৪। পড়াশোনা পুরোটাই ভারতে। জামশেদপুর থেকে সোনার পদক পেয়ে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মীরা। কাজ করেছেন কলকাতাতেও।
২০ বছর ইউনিলিভারে কাজ করার পর তাদের চিফ হিউম্যান রিসোর্স অফিসার হয়েছিলেন মীরা। পরে যোগ দেন শ্যানেলে। নিজেকে প্রাক্তন পেপসিকো প্রধান ইন্দ্রা নুয়ির ছাত্রী বলে ঘোষণা করা মীরা ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে এই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সিইও-র দায়িত্ব পালন করছেন।