তিমিরও মুখে বুলি ফোটে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য আছে ভাষা। তিমিরা যোগাযোগ এবং অনুভূতির জন্য বিভিন্ন ধরনের শব্দ ব্যবহার করে থাকে। সমুদ্রে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রজাতির তিমিরা যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করে আলাদা আলাদা ভাষা। শুনতে অবাক লাগলেও এক প্রজাতির তিমির মধ্যে সেই ভাষায় রয়েছে সাঙ্কেতিক বর্ণমালা!
দাঁতযুক্ত তিমিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতির তিমি হল স্পার্ম হোয়েল। ক্যামেরার ক্লিকের মতো শব্দের মাধ্যমে তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এই শব্দটিকে গবেষকেরা নাম দিয়েছেন ‘কোডা’। স্পার্ম হোয়েলের গলা থেকে উৎপন্ন এই শব্দ কিছুটা মর্স কোডের মতো শোনায়।
স্পার্ম হোয়েল প্রজাতির তিমিরা মনের ভাব প্রকাশ করতে প্রায় মানুষের কথা বলার মতোই বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট বর্ণ প্রয়োগ করে থাকে। আর সেই বর্ণের কাঠামো খুঁজে পাওয়ার জন্য এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শরণাপন্ন হয়েছেন জীববিজ্ঞানীরা। একই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন এক ভারতীয় গবেষকও।
এমআইটি কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবরেটরির পিএইচডি ছাত্রী প্রত্যুষা শর্মা কান পেতে শুনতে চান তিমিদের কথা। জলের প্রাণীরা কী ভাবে ভাব বিনিময় করে সেই ভাষা বুঝতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করছেন প্রত্যুষাও।
তিমির শরীরে বিশেষ এক ধরনের ‘ভয়েস বক্স’ বা স্বর তৈরির স্থান থাকে। তিমিরা এই স্বরযন্ত্র বা ভয়েস বক্সের মাধ্যমে জলের নীচে গানের মতো শব্দ তৈরি করে। এই শব্দ দিয়ে তিমি তাদের সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীরা জলে অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের সীমিত কার্যকারিতার কারণে শব্দের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
পৃথিবীর যে কোনও প্রাণীর মধ্যে শুক্রাণু তিমির মস্তিষ্ক সবচেয়ে বড়, মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় পাঁচ গুণ। সাধারণত দলগত ভাবেই এরা বসবাস করে। এক একটি দলে ১০টি করে স্পার্ম হোয়েল থাকতে পারে। এদের গোষ্ঠী মাতৃতান্ত্রিক। তিমির এই বিশেষ প্রজাতিটি ১৮ মিটার বা ৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং সমুদ্রে দলবদ্ধ ভাবে ঘুমোতে ভালবাসে।
১৯৭১ সালের সায়েন্স ম্যাগাজ়িনের একটি প্রবন্ধে সিটাসিয়ান ট্রান্সলেশন ইনিশিয়েটিভের প্রধান উপদেষ্টা, রজার পেইন দাবি করেছিলেন যে, হাম্পব্যাক তিমিরা গান গাইতে পারে। প্রত্যুষা তাঁর গবেষণায় দাবি করেছেন, স্পার্ম হোয়েলের ডাক পেইনের রেকর্ড করা হাম্পব্যাক তিমির সুরেলা গানের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা।
প্রত্যুষা দ্য টেলিগ্রাফকে জানিয়েছেন, স্পার্ম হোয়েলের ভাষা বেশ জটিল ও ছন্দবদ্ধ। এর নির্দিষ্ট ধরন ও নকশা রয়েছে। সেই ধরন অনেকটা গলা বা মুখ দিয়ে ড্রাম বাজানোর মতো শব্দ। একে বিটবক্সিং বলা হয়ে থাকে। এই দিয়েই জটিল শব্দের ভাষা তৈরি করে তিমির এই প্রজাতিটি।
গবেষকদের মতে, তিমির গানের যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকে, তা খুবই স্বল্প। এটি অনেক সময় জাহাজের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে মিলে যায়। প্রত্যুষা এবং তাঁর দল ডিজিটাল অ্যাকোস্টিক রেকর্ডিং ট্যাগ ব্যবহার করেছেন তিমির ডাক রেকর্ড করতে। এই যন্ত্রটিকে তিমির শরীরে অস্থায়ী ভাবে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়।
এই যন্ত্রে ধরা পড়ে জলের নীচে তিমিগুলি কেমন আচরণ করছে। এদের অবস্থান বা গতিবিধি ধরা পড়ে যন্ত্রে। জলের নীচে তিমির কণ্ঠস্বর রেকর্ড করার জন্য মাইক্রোফোন, অ্যাক্সিলোমিটার, জ়াইরোস্কোপ এবং ম্যাগনেটোমিটার ব্যবহার করা হয় তিমিদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সমুদ্রের কতটা গভীরে এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে তা জানার জন্য সেন্সর ব্যবহার করা হয় বলে জানান প্রত্যুষা।
স্পার্ম হোয়েলদের পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করার ভিন্ন ভিন্ন কোডা রয়েছে। সমন্বয় করার কোডার সঙ্গে মিল থাকে না নিজের পরিচয় দেওয়া বা আনুগত্য স্বীকারের কোডার। আবার শিকারের সময় দলের সদস্যেরা সম্পূর্ণ পৃথক একটি কোডা ব্যবহার করে থাকে।
এই সময় একটি ভিন্ন ধরনের কোডা ব্যবহার করে তারা, যাকে ইকোলোকেশন বলা হয়। এর আগে ধারণা করা হত, স্পার্ম হোয়েল স্রেফ ২১ ধরনের কোডা ব্যবহার করে। এর প্রায় নয় হাজার রেকর্ডিং নিয়ে গবেষণা করার পর এমন ১৫৬ ধরনের কোডা শনাক্ত করেছেন গবেষকেরা।
প্রাণীরা কী ভাবে কথা বলে, সেই নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে যুগান্তকারী সাফল্য এসেছে। ২০১৬ সালে মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে গবেষকেরা মিশরীয় ফলবাদুড়দের খাবার নিয়ে ঝগড়া এবং বিশ্রামের জায়গা নিয়ে ঝগড়ার মধ্যে ডাকের পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন।
বিজ্ঞানীরা একই পন্থা নিয়েছেন তিমির কোডার রহস্যভেদ করার জন্য। একে অপরকে কী বলে তা বোঝার জন্য মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্য নিতে শুরু করেছেন তাঁরা। মেশিন লার্নিং এমন সিকোয়েন্স মডেল তৈরি করা হয়েছে, যা তিমির ডাক এবং সংশ্লিষ্ট আচরণের সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরে ফেলতে সক্ষম হয়।
প্রত্যুষাদের এই গবেষণার মূল নির্যাসটি নেচার কমিউনিকেশনস প্রবন্ধ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ও তাঁর দল স্পার্ম হোয়েল ক্লিকের ৮ হাজার ৭০০টিরও বেশি শব্দ বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা দাবি করেছেন যে, তাঁরা চারটি মৌলিক উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। এটি একটি ‘ফোনেটিক বর্ণমালা’ তৈরি করে।
প্রত্যুষা জানিয়েছেন, তিমিরা বর্ণমালাকে অসংখ্য শব্দের সংমিশ্রণে ব্যবহার করতে পারে, ঠিক যেমন মানুষ শব্দ তৈরির জন্য বর্ণ এবং বাক্য তৈরির জন্য শব্দ একত্রিত করে।