ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নয়, সকলেই হতে চান জলদস্যু! স্বপ্নপূরণ হলে তো আর কথাই নেই। কারণ এতে রয়েছে রোমাঞ্চকর জীবনের হাতছানি। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে একটা পণ্যবাহী জাহাজ অপহরণ করতে পারলে কেল্লা ফতে। সেখানকার মাঝি-মাল্লাদের পণবন্দি রাখলে পকেটে আসে কোটি কোটি টাকা। নাবিকদের কাছে তাই মূর্তিমান যম সোমালিয়ার জলদস্যুরা। অন্য দিকে, সব জেনেও আফ্রিকার দেশটির বাসিন্দারা ‘রবিনহুড’ মনে করে তাঁদের।
কেন হঠাৎ সোমালিয়ার প্রায় সকলেই জলদস্যু হওয়ার জন্য পাগল? এর নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে ফাঁস হয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলির কুকীর্তি। পাশাপাশি, আফ্রিকার দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আর্থিক সঙ্কট এতে যথেষ্ট হাওয়া দিয়েছে। সমস্যার সূত্রপাত গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে। তখন অবশ্য দু’টি ভাগে বিভক্ত ছিল সোমালিয়া।
উত্তর সোমালিয়ায় দীর্ঘ দিন ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। আর দক্ষিণ সোমালিয়া শাসন করত ইটালি। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভের পর দু’টি অংশ জুড়ে জন্ম হয় ঐক্যবদ্ধ সোমালিয়ার। এর ঠিক ন’বছরের মাথায় আফ্রিকার দেশটিতে পড়ে শনির কু’নজর। আচমকাই দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ হারান সোমালিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদিরশিদ আলি। তারিখ ছিল ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর।
প্রেসিডেন্ট খুন হতেই সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সোমালিয়ার ফৌজ। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল মহম্মদ সিয়াদ বারে। ক্ষমতা ধরে রাখতে পরবর্তী দশকগুলিতে ফৌজি জেনারেলরা জাতি সংঘর্ষকে উস্কানি দিতে শুরু করেন। ফলে ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে আফ্রিকার এই দেশ।
নব্বইয়ের দশকে সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করে। ১৯৯১ সালের ২৭ জানুয়ারি বিদ্রোহীদের হাতে স্বৈরাচারী জেনারেল সিয়াদ বারের সরকারের পতন হয়। এর পর যে গৃহযুদ্ধ থেমে গিয়েছিল, এমনটা নয়। বরং কুর্সিতে কে বা কারা বসবেন, তা-ই নিয়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ চলতেই থাকে। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো দেশের উত্তর অংশ আলাদা হয়ে সোমালিল্যান্ড নামে নতুন ‘দেশ’ আত্মপ্রকাশ করে। যদিও আন্তর্জাতিক ভাবে এখনও সেটা স্বীকৃতি পায়নি।
অন্য দিকে টানা গৃহযুদ্ধ, সেনাবাহিনীর স্বৈরশাসন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে একেবারে খাদের মধ্যে গিয়ে পড়ে সোমালিয়ার অর্থনীতি। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে সংঘর্ষ ও অনাহারে আফ্রিকার দেশটিতে প্রাণ হারান সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ। সোমালিয়াবাসীর জলদস্যু হতে চাওয়ার নেপথ্যে একে অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে গণ্য করেন দুনিয়ার তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় সোমালিয়া যখন টালমাটাল, তখন এর সৈকত সংলগ্ন সামুদ্রিক এলাকায় দেদার চলতে থাকে মাছ চুরি। আফ্রিকার দেশটির ছিল না কোনও উপকূলরক্ষী বাহিনী। ফলে বিদেশি মৎস্যজীবীদের পোয়াবারো। বড় বড় ট্রলার নিয়ে দিব্যি সোমালিয়ার জলসীমায় ঢুকে বিপুল পরিমাণে মাছ শিকার করে চম্পট দিতেন তাঁরা। এতে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের যে পেটে লাথি পড়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০০৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, ফি বছর সোমালিয়ার জলসীমা থেকে ৩০ কোটি ডলারের সামুদ্রিক খাদ্য চুরি করা হয়েছে। বিদেশি মৎস্যজীবীরা দেশটির সামুদ্রিক সীমায় ঢুকে লোহার শিকলে বাঁধা জাল ফেলে মাছ ধরা শুরু করে। এতে সেখানকার প্রবালপ্রাচীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো প্রযুক্তি সোমালিয়াবাসীর হাতে ছিল না। উপরন্তু এই নিয়ে প্রতিবাদ করলে বিদেশি মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে।
সোমালিয়াবাসীর জলদস্যু হওয়ার নেপথ্যে দ্বিতীয় কারণ হল, দেশটির উপকূলে জমে থাকা বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যের স্তূপ। আশির দশক থেকেই ইউরোপীয় সংস্থাগুলি সোমালিয়ার উপকূলে বিষাক্ত শিল্পবর্জ্য ফেলা শুরু করে। ১৯৯১ সালে সিয়াদ বারের সরকারের পতনের পর, এ ব্যাপারে তাদের বারণ করার আর কেউ ছিল না। প্রথম দিকে বিষাক্ত বর্জ্য উপকূলভূমিতে ফেলা হত। পরে এর জন্য বেছে নেওয়া হয় সোমালিয়ার জলসীমাকে।
সোমালিয়ার উপকূলে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার ব্যাপারে এগিয়ে রয়েছে সুইৎজ়ারল্যান্ড, ইটালি, জার্মানি এবং ফ্রান্সের একাধিক বর্জ্য পরিচালক সংস্থা। প্রথম দিকে শুধুমাত্র পরমাণু বিদ্যুৎ চুল্লির বর্জ্যই সেখানে ফেলা হত। কিন্তু পরবর্তী কালে এতে যুক্ত হয় চিকিৎসা বর্জ্য। এগুলির প্রক্রিয়াকরণে কয়েক কোটি ডলার খরচ হয়ে থাকে। সেই টাকা বাঁচাতে সোমালিয়াকে বেছে নেয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি।
রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, সোমালিয়ার উপকূলে বর্জ্য ফেলার খরচ টন প্রতি আড়াই ডলার। সেখানে সেগুলির প্রক্রিয়াকরণে টনপ্রতি ২৫০ ডলার খরচ করতে হয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে। আর তাই ইউরোপীয় বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাগুলি সোমালিয়ার বিবাদমান জাতিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে। হাতিয়ারের জন্য বিপুল টাকা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে ওই সমস্ত কোম্পানি। বিনিময়ে উপকূল এবং সংলগ্ন সমুদ্রে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলতে থাকে তারা।
১৯৯৪ সালে এই সমস্ত ঘটনার উপর তদন্তমূলক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ইটালির টিভি সাংবাদিক ইলারিয়া আল্পি। একে ‘আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য বর্জ্য’ (গানস ফর ওয়েস্ট) নাম দেন তিনি। সোমালিয়ায় তখন জোয়ারের জলের মতো ঢুকছে হাতিয়ার। তার একাধিক প্রমাণ দুনিয়ার সামনে আনেন আল্পি। কিন্তু হঠাৎ খুন হতে হয় তাঁকে। অনেকেই মনে করেন ‘আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য বর্জ্য’তে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছিলেন ইটালির মাফিয়ারা। আর সেই জন্যই প্রাণ গিয়েছিল সাংবাদিক আল্পির।
২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ভারত মহাসাগরে সুনামি এলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় উপকূল এবং সমুদ্রের যাবতীয় বিষাক্ত বর্জ্য পৌঁছে দেয় সোমালিয়ার বাড়িতে বাড়িতে। ফলে গ্রামে গ্রামে বাড়তে থাকে রোগ-ব্যাধি। ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়িয়ে পড়ে ক্যানসার। কারও কারও মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। চর্মরোগে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বহু সোমালিয়াবাসী।
এই পরিস্থিতিতে একরকম জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে উপকূলে টহলদারি শুরু করেন সোমালিয়া মৎস্যজীবীদের একাংশ। স্থানীয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মেলান তাঁরা। ফলে সহজেই মিলে যায় হাতিয়ার। বিদেশি মৎস্যজীবীদের ট্রলার দেখলেই তাতে হামলা করতেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, নিজেদের উপকূলরক্ষী বাহিনী বলে পরিচয় দিতে শুরু করে সোমালিয়ার ওই সমস্ত মৎস্যজীবী।
কিছু দিনের মধ্যেই এই গোষ্ঠীগুলি বুঝতে পারে, পণ্যবাহী জাহাজ অপহরণ করে বিপুল টাকা রোজগার করা সম্ভব। সেইমতো জাহাজের নাবিক ও অন্য মাঝি-মাল্লাদের পণবন্দি রেখে মুক্তিপণ বাবদ কোটি কোটি টাকা আদায় করতে থাকে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। ১৯৯৮ সাল আসতে আসতে আফ্রিকার দেশটিতে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে। ফলে যুবসমাজ এই ‘পেশা’কেই আয়ের সহজতম রাস্তা হিসাবে বেছে নিতে দ্বিতীয় বার ভাবেনি।
২০০৫ সালের মধ্যে সোমালিয়ার পুটল্যান্ড এলাকা জলদস্যুদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। অঞ্চলটি কৃষির পক্ষে একেবারে অযোগ্য হওয়ায় সেখানকার ১৫-১৬ বছরের কিশোরেরা ডাকাতদের দলে ভর্তি হতে থাকে। সুপরিকল্পিত ভাবে পণ্যবাহী জাহাজ অপহরণ করত তারা। গোটা অপারেশন পরিচালনার জন্য স্থানীয় গুন্ডারা একরকম সংস্থা খুলে বসে। লুট করা অর্থের একটা বড় অংশ নিজেদের কাছে রেখে বাকিটা ভাগ করে দিতে থাকেন তাঁরা।
জলদস্যুবৃত্তির জন্য সোমালিয়ার অবস্থানকেও দায়ী করেন বিশ্লেষকেরা। আফ্রিকার উত্তর-পূর্বের দেশটির পূর্ব দিকে রয়েছে ভারত মহাসাগর এবং উত্তরে লোহিত সাগর লাগোয়া এডেন উপসাগর। এই রাস্তা দিয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালিত হয়। আফ্রিকার দেশটির উপকূল ঘেঁষে ইউরোপ এবং আমেরিকার পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করায় সেগুলিকে অপহরণ করতে সোমালিয়ার জলদস্যুদের সে ভাবে বেগ পেতে হয়নি।
অপহৃত জাহাজের নাবিকদের মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহের ব্যাপারটিও বেশ চমকপ্রদ। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির অন্যতম বড় শহর দুবাইয়ের ব্যাঙ্ক মারফত সাধারণত টাকা নিয়ে থাকে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। প্যারাসুটে করে সেই টাকা তাদের বলে দেওয়া জাহাজের উপর ফেলতে হয়। অর্থ হাতে আসার পর নাবিকদের ছেড়ে দিতে অবশ্য দেরি করে না তারা।
সোমালিয়ার জলদস্যুদের অবশ্য দাবি, জাহাজ অপহরণ করে মুক্তিপণ নেওয়া হচ্ছে না। দেশে কোনও সরকার না থাকায় কর আদায় করছে তারা। স্থানীয় ভাষায় এই জলদস্যুদের নাম ‘বাধাধিন্দা বাধা’। অর্থাৎ সমুদ্রের রক্ষাকর্তা। সংবাদ সংস্থা বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোমালিয়ার জলদস্যুরা জাহাজ অপহরণ করে ৩৩ কোটি ৯০ লক্ষ থেকে ৪১ কোটি ৩০ লক্ষ ডলার পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল।
সোমালিয়ার জলদস্যুদের শায়েস্তা করতে ২০০৯ সালে আসরে নামে আমেরিকা। মিত্র দেশগুলির নৌসেনাকে সঙ্গে নিয়ে আফ্রিকার দেশটির আশপাশে টহলদারি শুরু করে ওয়াশিংটন। এ ব্যাপারে এগিয়ে আসে নেটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমস্ত দেশ। পাশাপাশি সোমালিয়ার জলসীমা সংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধজাহাজ পাঠায় ভারত, চিন এবং রাশিয়াও।
২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সোমালিয়া সংলগ্ন এলাকায় ১৪টি দেশের অন্তত ২০টি রণতরী সব সময়ে টহল দিয়েছে। ফলে পণ্যবাহী জাহাজ অপহরণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায়। ২০১১ সালে আফ্রিকার দেশটির জলদস্যুদের হাতে অপহৃত হওয়া পণ্যবাহী জাহাজের সংখ্যা ছিল ২৩৭। সেটাই ২০১২ এবং ২০১৩ সালে যথাক্রমে ৭৫ এবং ১৫-তে নেমে আসে।
কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে প্যালেস্টাইনপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হামাস, হিজ়বুল্লা এবং হুথিদের সঙ্গে ইজ়রায়েলের যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতি ফের অন্য দিকে মোড় নেয়। ওই বছর থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের নভেম্বরের মধ্যে ফের তিনটি পণ্যবাহী জাহাজ অপহরণ করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তার মধ্যে একটি চিনের এবং একটি বাংলাদেশের জাহাজ ছিল। গত বছরের মার্চে ৪০ ঘণ্টার অপারেশন চালিয়ে একটি পণ্যবাহী জাহাজকে অপহরণ হওয়ার হাত থেকে বাঁচায় ভারতীয় নৌসেনা। তাঁদের হাতে ধরা পড়ে সোমালিয়ার বেশ কয়েক জন জলদস্যু।
এ ছাড়া আফ্রিকার দেশটির বেশ কিছু জলদস্যুকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আমেরিকা। মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে প্রাণ গিয়েছে তাঁদের কয়েক জনের। তার পরও সোমালিয়াবাসী পুরোপুরি জলদস্যুতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। উল্টে সেখানকার ৭০ শতাংশ জনতা এই ধরনের দুষ্কৃতীদের সমুদ্রের রক্ষাকর্তা বলে মনে করেন। আগামী দিনে পশ্চিম এশিয়ায় অশান্তি বাড়লে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দাপাদাপি ফের চরম সীমায় উঠবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।