মুকেশ অম্বানী হোন বা রতন টাটা, শিল্পপতি হিসাবে তাঁদের নাম শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে উচ্চারিত হয়। ভারতের মাটিতে ব্যবসা শুরু করে বিশ্বের বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া ভারতীয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বিদেশের মাটিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সাফল্যের বহু গল্প আমাদের জানা। তেমনই এক জন সম্প্রতি আবারও আলোচনায় উঠে এসেছেন। তিনি হলেন গোপীচন্দ হিন্দুজা।
বর্তমানে গোপীচন্দ হিন্দুজা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান। সম্প্রতি, ইংল্যান্ডের সানডে টাইমস ম্যাগাজ়িন সে দেশের হাজার জন ধনী ব্যক্তি এবং পরিবারের তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকার শীর্ষে রয়েছে গোপীচন্দের নাম।
২০২৩ সালে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হিন্দুজা পরিবারের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৩৭২০ কোটি পাউন্ড। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, তাদের সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার কোটি পাউন্ড। যা সে দেশের সব ধনী ব্যক্তি এবং পরিবারকে টপকে উপরে উঠে এসেছে।
ধনীদের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করা হিন্দুজা পরিবারের এই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে গোপীচন্দ এবং তাঁর দাদা শ্রীচন্দ ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। আরও লক্ষণীয় বিষয়, হিন্দুজা পরিবার ব্রিটেনে টানা ছ’বার ধনীদের এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
গোপীচন্দ হিন্দুজা পরিবারের মেজো ছেলে। পরমানন্দ দীপচাঁদ হিন্দুজা এবং যমুনাদেবীর চার সন্তান। শ্রীচন্দ এবং গোপীচন্দ ছাড়া প্রকাশ এবং অশোকও হিন্দুজা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। চার ভাই মিলে পরমানন্দের শুরু করা ব্যবসাকে সফল ভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
১৯৪০ সালের ২৯ জানুয়ারি হিন্দুজা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন গোপীচন্দ। মুম্বইয়ের (তৎকালীন বম্বে) জয় হিন্দ কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। তার পর লন্ডনের রিচমন্ড কলেজ থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন।
পড়াশোনা চলাকালীনই ১৯৫৯ সালে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন তিনি। সেই থেকে দাদা-বাবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে অবিচল গোপীচন্দ।
সিন্ধু (বর্তমানে পাকিস্তান) অঞ্চলের বাসিন্দা পরমানন্দ ১৯১৪ সালে তাঁর ব্যবসা শুরু করেন। কাপড়ের ব্যবসা দিয়ে শুরু করা হিন্দুজা পরিবারের ব্যবসা এখন নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাঙ্কিং, তথ্যপ্রযুক্তি, গাড়ি, তেল, সাইবার নিরাপত্তা, বিনোদন, গণমাধ্যম-সহ আরও অনেক ব্যবসা রয়েছে হিন্দুজা পরিবারের। এমনকি, রিয়্যাল এস্টেট দুনিয়াতেও হিন্দুজা গোষ্ঠী পরিচিত নাম। বিশ্বের ৪৮টি দেশে তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে।
১৯৮০-র দশকে হিন্দুজা গ্রুপের ব্যবসা দুনিয়ায় দু’টি উল্লেখযোগ্য অধিগ্রহণ ছিল গাল্ফ অয়েল (আগে নাম ছিল শেভরন) এবং অশোক লেল্যান্ড।
হিন্দুজা গোষ্ঠীর একটি বিলাসবহুল হোটেল নিয়ে আলোচনা হয়। সম্প্রতি এই গ্রুপ উইনস্টন চার্চিলের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি শিবিরকে হোটেলে পরিণত করেছে। সেই হোটেল তৈরিতে খরচ হয়েছিল ৩৭০০ কোটি টাকা।
এই বিলাসবহুল হোটেলে একটি বলরুম রয়েছে। যেখানে ৬০০ জন একসঙ্গে থাকা যায়। এ ছাড়াও এখানে একটি ৮৪ ফুট লম্বা পুল রয়েছে। দুই কামরাবিশিষ্ট ৮৫টি ঘর আছে এই হোটেলে। পাশাপাশি এই বিলাসবহুল হোটেলে স্পা, বার, ওয়াইন সেলার রয়েছে।
১৯৭১ সালে পরমানন্দের মৃত্যুর পর চার ভাই মিলে পারিবারিক ব্যবসা সামলাচ্ছেন। ২০২৩ সালে শ্রীচন্দের মৃত্যুর পর গোপীচন্দই হিন্দুজা গ্রুপের কর্ণধার হন।
নব্বইয়ের দশক থেকে ধারাবাহিক ভাবে ইংল্যান্ড এবং এশিয়ার ধনী পরিবারদের তালিকায় থেকেছে হিন্দুজা গোষ্ঠী। ২০১৪ সালে যখন হিন্দুজা গোষ্ঠী এই তালিকায় শীর্ষে উঠেছিল, তখন তাদের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি ডলার।
গোপীচন্দ এবং সুনীতা হিন্দুজার তিন সন্তান। দুই পুত্র সঞ্জয় এবং ধীরজ ও এক কন্যা রীতা। ২০১৫ সালে সঞ্জয়ের জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে কম চর্চা হয়নি। উদয়পুরে বসেছিল সঞ্জয়ের বিয়ের আসর। হলি-বলি তারকাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। সূত্রের খবর, সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচ হয়েছিল দেড় কোটি পাউন্ড।
ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও এবং ব্যবসা থাকলেও বর্তমানে গোপীচন্দ থাকেন ব্রিটেনেই। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করেন তিনি।
শ্রীচন্দের মৃত্যুর পর হিন্দুজা গোষ্ঠীর মালিকানা নিয়ে পারিবারিক বিরোধের খবরও প্রকাশ্যে এসেছিল। শ্রীচন্দের পরিবারের দাবি ছিল, তাঁদের অবহেলা করা হচ্ছে। তার পর থেকেই গোপীচন্দের পরিবারের থেকে তাদের দূরত্ব বজায় রাখতে দেখা গিয়েছে। তবে হিন্দুজা পরিবারের সমীকরণ এখনও স্পষ্ট নয়।
শ্রীচন্দের মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন গোপীচন্দ। তিনি ব্রিটেনে থাকলেও তাঁর ভাই প্রকাশ মোনাকোর বাসিন্দা। আর এক ভাই অশোক মুম্বই থেকেই ব্যবসা সামলাছেন।