উত্তরে চিন, পশ্চিমে পাকিস্তান। সমগ্র দক্ষিণ এবং পূর্ব, পশ্চিমের একাংশ সমুদ্রে ঘেরা। এই ভৌগোলিক অবস্থানই ভারতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।
চিন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই আদায়-কাঁচকলায়। ফলে উত্তর, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত বার বার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ ছাড়া, উপকূল দিয়েও শত্রুর আক্রমণ অসম্ভব নয়।
এ সব কারণে প্রথম থেকেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছে ভারত। একটা সময় ছিল, যখন বিদেশ থেকে শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র ভারতে আমদানি করা হত।
কিন্তু সময় বদলেছে। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়েছে ভারতের ‘আত্মনির্ভর’ মডেল। বর্তমানে দেশেই বিভিন্ন শক্তিশালী অস্ত্র তৈরি হয়। এমনকি, বিদেশে রফতানিও করা হয় ভারতে তৈরি অস্ত্র, যুদ্ধের সরঞ্জাম।
ভারতের তেমনই একটি নিজস্ব অস্ত্রের নাম ‘অর্জুন’। এটি এক ধরনের বিস্ফোরকবাহী ট্যাঙ্ক, যা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের ঘুম উড়িয়ে দিতে পারে।
মেন ব্যাটল ট্যাঙ্ক (এমবিটি) অর্জুন তৈরির জন্য কয়েক বছর আগে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডে অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। ১১৮টি ট্যাঙ্কের অর্ডার পেয়েছিল বোর্ড। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক প্রথম পাঁচটি হাতে পায় ২০২১ সালে। ২০২৫-’২৬ সালের মধ্যে বাকিগুলিও পাওয়া যাবে। উল্লেখ্য রাজস্থানের জয়সলমেরে দীপাবলি উদ্যাপনে গিয়ে এই ট্যাঙ্কে চড়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
তবে এই ট্যাঙ্কগুলি হাতে পাওয়ার পর নতুন করে আর ‘অর্জুনের’ প্রয়োজন হবে না ভারতের। কিন্তু ‘অর্জুনের’ উৎপাদন যাতে বন্ধ করে দিতে না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য এই ধরনের ট্যাঙ্ক বিদেশে রফতানি করা প্রয়োজন।
অর্জুন রফতানির জন্য আফ্রিকাকে বেছে নিয়েছে নয়াদিল্লি। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই ট্যাঙ্ক বিক্রি করবে ভারত। কারণ, আফ্রিকার ভূপ্রকৃতি এই ধরনের যুদ্ধাস্ত্রের পক্ষে উপযোগী।
অর্জুন ভারী ট্যাঙ্ক। পাহাড়ি অঞ্চলে এই ধরনের ট্যাঙ্ক ব্যবহারে খুব একটি সুবিধা করা যায় না। কিন্তু ভারতের প্রধান দুই ‘শত্রু’ রাষ্ট্র (চিন এবং পাকিস্তান) পাহাড়ি এলাকাতেই রয়েছে। তাই বেশি সংখ্যক অর্জুন ট্যাঙ্কের প্রয়োজন নেই ভারতের।
যদিও দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অর্জুন গুরুত্বপূর্ণ। মেন ব্যাটল ট্যাঙ্ক এখনও পর্যন্ত কয়েকটি মাত্র দেশই নিজে থেকে তৈরি করতে পেরেছে। তাদের মধ্যে আছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপানের মতো দেশ। ভারতও সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
আফ্রিকার দেশগুলিতে এই ধরনের ভারী এবং সুরক্ষিত ট্যাঙ্ক নেই। তাই আফ্রিকার অনেক দেশই নিজেদের সেনাবাহিনীতে অর্জুনকে শামিল করতে আগ্রহী।
আফ্রিকার দেশগুলিতে এত দিন প্রধান যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহকারী ছিল রাশিয়া। কিন্তু তারা ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে আফ্রিকায় রফতানি কিছুটা কমেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতকে বিকল্প হিসাবে দেখছে আফ্রিকার দেশগুলি।
আফ্রিকায় অস্ত্র রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের আরও একটি আগ্রহের বিষয় হল চিনের প্রতিরোধ। আফ্রিকা মহাদেশে প্রভাব বিস্তার করার জন্য চিন উঠেপড়ে লেগেছে। আফ্রিকার দেশকে সাহায্য করে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুললে চিনের প্রতিরোধে কিছুটা সুবিধা হতে পারে।
চিনে তৈরি অস্ত্রশস্ত্রের তুলনায় ভারতের পণ্য অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। তা ছাড়া, ভারতের পণ্য পশ্চিমি দেশগুলির তুলনায় দামেও কম। তাই আফ্রিকা ভারত থেকে অস্ত্র কেনার দিকে ঝুঁকেছে।
আফ্রিকার দেশগুলিতে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থানের মতো একাধিক নিরাপত্তাজনিত সঙ্কট দেখা দেয়। তাই ভারতের অর্জুন ট্যাঙ্ক তাদের কাজে লাগতে পারে। বাহরাইন এবং কলম্বিয়াও এই ট্যাঙ্কের অর্ডার দিতে পারে বলে জানিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি সূত্র।
২০০৪ সাল থেকে ভারতের সামরিক ক্ষেত্রে অর্জুন ট্যাঙ্কের ব্যবহার চালু রয়েছে। আগে থেকে ভারতের কাছে ১২৪টি ট্যাঙ্ক ছিল। ২০২১ সালে আরও ১১৮টি ট্যাঙ্কের অর্ডার দেওয়া হয়।
এই ট্যাঙ্কের কার্যকারিতা হল, অর্জুন খুব সহজেই এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। ট্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ। রাতেও এই ট্যাঙ্কের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব।
যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে খুঁজে খুঁজে মারে অর্জুন। সেই কারণে একে ‘হান্টার কিলার’ও বলা হয়ে থাকে। মহাভারতের মহান যোদ্ধা অর্জুনের নামে এই ট্যাঙ্কের নামকরণ করা হয়েছে।
পাহাড়ি এলাকায় অর্জুনকে কাজে লাগানো না গেলেও এই ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা হয় রাজস্থান সীমান্তে। ওই এলাকার জন্য অর্জুন উপযোগী বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
আফ্রিকায় অর্জুন ট্যাঙ্কের রফতানি প্রকল্প ৫০০ কোটি ডলারের (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা)। ট্যাঙ্ক সফল ভাবে বিক্রি করা গেলে এই টাকা ভারতের হাতে আসবে। তাতে ভারতের অর্থনীতি এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে।