দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের বুকে প্রবাল দ্বীপপুঞ্জে টিমটিম করে টিকে ছিল ব্রিটিশ রাজ। এ বার অস্ত গেল সেই সূর্যও। ফলে নামিয়ে ফেলা হচ্ছে ‘ইউনিয়ান জ্যাক’। যা ভারতীয় কূটনীতির বিরাট জয় হিসাবে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি মরিশাসের সঙ্গে একটি হস্তান্তর চুক্তিতে সই করে ব্রিটিশ সরকার। সেই চুক্তি অনুযায়ী দিয়েগো গার্সিয়া-সহ ‘চাগোস দ্বীপপুঞ্জ’-র সার্বভৌমত্ব এ বার ব্রিটিশদের থেকে পেতে চলেছে ওই ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র।
হস্তান্তর চুক্তিতে ৯৯ বছরের জন্য চাগোসকে মরিশাসের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত দিয়েগো গার্সিয়াতে রয়েছে আমেরিকা ও ব্রিটেনের নৌঘাঁটি। যা অবশ্য ব্যবহার করতে পারবে দুই দেশের ফৌজ।
চাগোসের অধিকার যাতে মরিশাস পায়, তার জন্য প্রথম দিন থেকেই সরব ছিল নয়াদিল্লি। নেপথ্য থেকে গত কয়েক দশক ধরে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে কূটনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে গিয়েছে সাউথ ব্লক। ব্রিটেন-মরিশাস হস্তান্তর চুক্তিকে নয়াদিল্লির সেই কূটনীতিরই জিত হিসাবে দেখছে ওয়াকিবহাল মহল।
উল্লেখ্য, ভারত মহাসাগরীয় এই প্রবাল দ্বীপপুঞ্জই ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশের শেষ নির্দশন। সেই ঔপনিবেশিকতা দূর করতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দৃঢ় ভাবে প্রচার চালিয়েছিল ভারত। আর তাই এই নিয়ে যৌথ বিবৃতিতে মরিশাস ও ব্রিটেন কেউই নয়াদিল্লির জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেনি।
হস্তান্তর চুক্তিতে সই হওয়ার পর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘এই রাজনৈতিক অবস্থানে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে আমাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আমেরিকা ও ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি। সেটা না থাকলে এই চুক্তি হয়তো বাস্তবে রূপ পেত না।’’
চাগোস দ্বীপপুঞ্জ হাতে পাওয়ার পর এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) করা পোস্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ জগন্নাথ। ‘‘ভারত সরকার বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদী-সহ সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ। ঔপনিবেশিকতা শেষ করার জন্য আমাদের লড়াইতে আপনাদের নিঃস্বার্থ সমর্থন পেয়েছি।’’
পাল্টা এই ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকও। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘ব্রিটেন ও মরিশাসের মধ্যে দিয়েগো গার্সিয়া-সহ চাগোস দ্বীপপুঞ্জ হস্তান্তরের চুক্তিকে স্বাগত জানাই। দু’বছর আলোচনার পর চাগোস বিরোধের চিরস্থায়ী সমাধান হল। এতে আন্তর্জাতিক আইনকেও সম্মান জানানো গিয়েছে।’’
ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে মোট ৬০টি ছোট ছোট প্রবাল দ্বীপের একটি মালা তৈরি হয়েছে। এরই নাম চাগোস দ্বীপপুঞ্জ। যার অন্যতম হল দিয়েগো গার্সিয়া। অনন্ত জলরাশির মধ্যে ৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যা গড়ে উঠেছে।
প্রবাল দ্বীপগুলির মধ্যে আকারের দিক থেকে দিয়েগো গার্সিয়াই সবচেয়ে বড়। ১৫১২ সালে যার সন্ধান পান পর্তুগিজ নাবিক পেড্রো মাসকারেনহাস। জায়গাটা জনমানবশূন্য হওয়ায়, তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি তিনি। পরবর্তী কালে স্পেনীয় অভিযাত্রী দিয়েগো গার্সিয়া দে মোগুয়ের ফের পৌঁছন ওই দ্বীপে। নিজের নামেই করেন প্রবাল প্রাচীরের নামকরণ। সালটা ছিল ১৫৪৪।
১৮ শতক পর্যন্ত দিয়েগো গার্সিয়াতে ছিল না কোনও বসতি। ১৭৭৮ সালে মরিশাসের ফরাসি গভর্নর লোকলস্কর পাঠিয়ে সেখানে শুরু করেন নারকেল চাষ। তাতে কাজে লাগানো হয় দাসদের। ১৭৮৬ সালে কুষ্ঠরোগীদের উপনিবেশ হিসাবে দিয়েগো গার্সিয়ার ব্যবহার শুরু করে ফ্রান্স।
১৮১৪ সালে ইউরোপে শেষ হয় দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের যুদ্ধ। এলবা দ্বীপে নির্বাসিত হন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। লড়াই হেরে যাওয়ায় দিয়েগো গার্সিয়া ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয় ফরাসি সরকার। চাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে যাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে শুরু করেন ইংরেজ প্রশাসকেরা। যা নিয়ে পরবর্তী কালে দেখা দেয় নতুন রাজনৈতিক জটিলতা।
১৯৬৮ সালের ১২ মার্চ ব্রিটেনের শাসন থেকে মুক্তি পায় মরিশাস। দ্বীপরাষ্ট্রটি স্বাধীনতা পেলেও চাগোসের ক্ষমতা ছিল ইংল্যান্ডের হাতেই। ওই সময়ে আমেরিকাকে নৌঘাঁটি তৈরির জন্য দিয়েগো গার্সিয়ার জমি লিজ় দেয় ব্রিটিশ সরকার। এই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ৫০ বছরের চুক্তি হয়েছিল। যা সম্প্রতি আরও ২০ বছর বৃদ্ধি করা হয়ছে। ফলে, ২০৩৬ পর্যন্ত সেখানে নৌবহর রেখে দিব্যি ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় নজরদারি চালাতে পারবে আমেরিকা।
এই পরিস্থিতিতে দিয়েগো গার্সিয়া তাদের দেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে দাবি তোলে মরিশাস। যা নিয়ে ২০১৭ সালে ২২ জুন রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় পাশ হয় একটি সম্মতিপত্র। যাতে এই নিয়ে মীমাংসার জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে (আইসিজে) অনুরোধ করা হয়েছিল। চাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে দিয়েগো গার্সিয়াকে আলাদা ভাবে দেখার বিষয়টিকে অবৈধ বলে জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক আদালত।
২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ভারত মহাসাগরীয় প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত। সেখানে বলা হয়, মরিশাস স্বাধীনতা লাভ করলেও সেখানকার ঔপনিবেশিকরণের সমাপ্তি আইনসম্মত ভাবে হয়নি। ফলে ব্রিটেনকে যত দ্রুত সম্ভব সেখানকার প্রশাসন চালানো থেকে সরে আসতে হবে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এই রায়ের পরেই চাপে পড়ে ব্রিটিশ সরকার। বাধ্য হয়ে ২০২২ সাল থেকে সমস্যা সমাধানের জন্য মরিশাসের সঙ্গে টানা আলোচনা চালায় ইংল্যান্ড। শেষ পর্যন্ত প্রবাল দ্বীপগুলি হস্তান্তরে রাজি হয়েছে ব্রিটেন।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, দিয়েগো গার্সিয়ার অবস্থানের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এর কৌশলগত গুরুত্ব। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এর দূরত্ব মাত্র ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় নজরদারি চালানোর জন্য এই দ্বীপকে ব্যবহার করে আমেরিকা।
এ ছাড়া ওই দ্বীপে বছরের পর বছর ধরে থাকার ফলে উন্নত সামরিক পরিকাঠামো তৈরি করেছে আমেরিকা। বিগত কয়েক বছর ধরেই যাদের রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে চিন। দিয়েগো গার্সিয়া হাতে থাকলে খুব সহজেই সেখান থেকে নৌবহর পাঠিয়ে দক্ষিণ চিন সাগর বা জাপান সাগর পর্যন্ত বেজিংয়ের আগ্রাসন রুখতে পারবে ওয়াশিংটন। শুধু তা-ই নয়, সে ক্ষেত্রে তাইওয়ান আক্রমণের আগেও দু’বার ভাবতে হবে চিনকে।
দিয়েগো গার্সিয়ার এই কৌশলগত অবস্থান এবং সেখানে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি থাকার কারণেই এর হস্তান্তরে প্রথম পর্যায়ে রাজি ছিল না ব্রিটেন। মরিশাস সরকার সামরিক ঘাঁটি থাকার বিষয়টি মেনে নেওয়ায় সমস্যা মিটে যায়। এর পরই দ্রুত চুক্তিপত্রে সই করে দিয়েছে ব্রিটেন।