দার্জিলিংয়ের উত্তরে চিনের সীমান্তের মাঝে রয়েছে ভুটান। মাত্র ৩৮ হাজার বর্গ কিলোমিটারের এই পাহাড়ি দেশটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। ওই অঞ্চলে চিনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতও ভূপ্রকৃতিগত অবস্থানের কারণে ভুটান আড়াল করে থাকে।
ভূপ্রকৃতিগত দিক থেকে পড়শি হিসাবে ভুটানের গুরুত্ব তাই অপরিসীম। কিন্তু এই পড়শি নিয়েই সম্প্রতি ভারতের চিন্তা বেড়েছে। চিনের গ্রাসে চলে যাচ্ছে ভারতের পড়শি দেশ।
সম্প্রতি ভুটানের জাকারলুং উপত্যকার বেশ কিছু উপগ্রহচিত্র প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে দেখা গিয়েছে, ২০২১ সালেও উপত্যকার যে যে অংশ ফাঁকা ছিল, ২০২৩ সালে সেখানে গড়ে উঠেছে ইমারত।
চিনা ফৌজ ভুটানের সীমানা লঙ্ঘন করে ভিতরে ঢুকে লাগাতার অবৈধ নির্মাণ করে চলেছে। একের পর এক বহুতল গড়ে উঠছে পাহাড়ি জঙ্গল সরিয়ে।
ভুটানের জমিতে মূলত গ্রাম এবং সেনাছাউনি তৈরি করছে চিন। উপগ্রহচিত্রে দেখা গিয়েছে, ভুটানের যে অংশে চিন পৌঁছে গিয়েছে, সেখান থেকে অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে।
সম্প্রতি যেখানে চিনের অবৈধ নির্মাণের খোঁজ মিলেছে, সেই জাকারলুং প্রদেশ সংস্কৃতিগত দিক থেকে ভুটানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। ভুটানি সংস্কৃতিও চিনা আগ্রাসনের গ্রাসে ডুবে যেতে পারে।
চিনের এই আগ্রাসনের বিষয়ে সব জেনেও হাত গুটিয়ে বসে ভুটানের প্রশাসন। কারণ চিনকে ঠেকানোর মতো ক্ষমতা উত্তর-পূর্বের এই দুর্বল পড়শি দেশটির নেই।
সম্মুখসমর এড়িয়ে কথাবার্তার মাধ্যমে চিনের সঙ্গে সীমান্তের বিষয়ে সমঝোতার চেষ্টা আগেও করেছে ভুটান। ১৯৯৮ সালে জাকারলুং-সহ একাধিক বিতর্কিত এলাকার মর্যাদা প্রসঙ্গে চিন এবং ভুটানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেখানে ভুটানে হস্তক্ষেপ না করতে রাজি হয়েছিল চিন। কিন্তু ওই চুক্তিকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।
চিনের অনুপ্রবেশ, বাড়বাড়ন্ত বন্ধ করার জন্য বার বার উদ্যোগী হয়েছে ভুটান। তারা চিনের সঙ্গে মেলামেশা বাড়িয়েছে। সুসম্পর্ক গঠনের জন্য একাধিক পদক্ষেপ করা হচ্ছে। ‘নরম পন্থা’য় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভুটান সরকার।
ভুটানের বিদেশমন্ত্রী তান্ডি ডোরজি গত অক্টোবরেই ভুটানে গিয়েছিলেন। যা আগে কখনও হয়নি। ওই একই মাসে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং চিন এবং ভুটানের মধ্যে সীমারেখা নির্দেশক এঁকে দেওয়া হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
‘হিন্দু’ পত্রিকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী চিনের সঙ্গে ভুটানের জমি বদলের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। জল্পনা ছিল, চিন যদি ডোকলাম মালভূমির উপর তাদের দাবি ছেড়ে দেয়, তবে জাকারলুঙে যে জমিতে তারা গ্রাম তৈরি করেছে, সেই জমি ভুটান তাদের দিয়ে দিতে রাজি আছে। এই জল্পনা উড়িয়ে দেননি শেরিং।
২০১৭ সালে ডোকলামে চিনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনার সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ওই এলাকায় চিনের অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল ভারত। ভুটান সেই সময় জানিয়েছিল, ভারত এবং চিন উভয় পক্ষকেই খুশি করে, এমন সিদ্ধান্ত নেবে ভুটান।
ভারতের সঙ্গে ডোকলামে সংঘর্ষের পরেও চিন অন্তত তিনটি গ্রাম ওই অঞ্চলে গঠন করে ফেলেছে। দক্ষিণ দিকে আর এক চুলও এগোলে নয়াদিল্লির কাছে তা বড় উদ্বেগের কারণ হতে বাধ্য।
ভুটানের জমি ধরে চিন দক্ষিণে আর অগ্রসর হলে শিলিগুড়ি করিডরের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলবে বেজিং। ওই করিডরের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারতের বাকি অংশের যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একাধিক বার সতর্কতা জারি করেছে ভারতীয় সেনা।
তবে ভারতের লাগাতার বিরোধিতা সত্ত্বেও ভুটানের জমিতে চিনের অগ্রসর অন্য দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ওই এলাকায় একটি ভূ-কৌশলগত পুনর্বিন্যাস হতে পারে।
অনেকের মতে ক্রমশ চিনের দিকে ঝুঁকছে ভারতের পড়শি দেশ। তারা চিনের সঙ্গে সমঝোতায় চলে যেতে পারে। ভারতের সে ক্ষেত্রে বসে বসে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
এমনিতেই ভারতের উত্তর-পশ্চিম মোটামুটি ভাবে চিনের ‘আয়ত্তে’। পাকিস্তান বরাবরই ভারতের বিরুদ্ধে। চিনঘেঁষা হিসাবে তাদের পরিচয় রয়েছে। আফগানিস্তানেও চিনের আধিপত্য কম নয়।
দক্ষিণে শ্রীলঙ্কাতে ধীরে ধীরে চিন প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। মলদ্বীপেও চিনঘেঁষা শাসক ক্ষমতায় এসেছেন। ভারতীয় সেনাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে উত্তর-পূর্বে ভুটানকেও চিন যদি ‘আয়ত্তে’ এনে ফেলে, তবে নয়াদিল্লির আকাশে অস্বস্তির মেঘ ঘনাতে বাধ্য। চিনা আগ্রাসন থেকে ভুটানকে রক্ষা করতে ভারত কোনও পদক্ষেপ করে কি না, সেটাই এখন দেখার।