সৌদি আরব থেকে কেরলের প্রান্তে ফোন। সন্ত্রাসবাদীরা ফোনের মাধ্যমেই তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, জরুরি তথ্য আদানপ্রদান করে চলেছে অনবরত। কিন্তু দেশের প্রতিরক্ষা দফতরকে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ করা কি এতই সহজ?
আন্তর্জাতিক ফোনকল রেকর্ড করলেই সব তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে যে! তবে উপায় কী? নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য তৈরি করা হয় অবৈধ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ পরিচালনকারী সংস্থা। সম্প্রতি তেমনই কিছু সংস্থার হদিস পেয়েছে কেরলের পুলিশ।
২০২১ সালে এই ধরনের আটটি অবৈধ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ পরিচালনকারী সংস্থা পুলিশের নজরে এসেছিল। সম্প্রতি আরও কিছু সংস্থা তাঁদের নজরে আসে। কোঝিকোড়-ভিত্তিক র্যাকেটের কার্যকলাপের তদন্তের সময় পুলিশ এই সংস্থাগুলির খোঁজ পায়। এই অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলির নেপথ্যে রয়েছে ‘প্যান-ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক’-এর ভূমিকা। বেশির ভাগ সংস্থা কেরলের কোঝিকোড়েই রয়েছে।
পুলিশি তদন্তে এই তথ্য প্রকাশ্যে আসায় রাজ্য পুলিশ দেরি না করে মামলাটি জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্তে জানা গিয়েছে, এই অবৈধ এক্সচেঞ্জগুলির মাধ্যমে প্রচুর অপরাধমূলক ফোন করা হয়েছিল।
যে সময় ‘বোটিম’, ‘জুম’ এবং ‘টোটোক’-এর মতো অনেক অ্যাপের মাধ্যমে শুধুমাত্র পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতেই নয়, অন্য দেশেও বিনামূল্যে যোগাযোগ করা যেত, সেই সময় এই টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছিল।
তদন্তে উঠে এসেছে, দেশের চোরাকারবারি এবং সন্ত্রাসবাদীরা যাতে নির্ঝঞ্ঝাটে তথ্য চালান করতে পারে, তাই বিদেশের সার্ভার কেনা হয়েছিল। বিএসএনএল সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল জেনারেল ম্যানেজার জি মুরলীধরন সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন, স্বাভাবিক আন্তর্জাতিক ফোনকল আদান-প্রদানের পদ্ধতিকে এড়িয়ে চলার জন্য অনৈতিক ভাবে এই ধরনের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ব্যবহার ক্রমবর্ধমান এবং এর ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতিও হচ্ছে।
সাধারণত আন্তর্জাতিক স্তরে কল পরিচালনা করার জন্য কয়েকটি সংস্থাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে ফোন করতে গেলে খরচও বেশি। কিন্তু অবৈধ টেলিফোন এক্সেঞ্জের মাধ্যমে কেউ ফোন করতে চাইলে, তিনি খুব কম খরচে ফোন করতে পারেন। ফলে, সস্তা বিকল্প উপায় হাতের কাছে থাকায় এই সংস্থাগুলিও সংখ্যায় বাড়তে থাকে।
কোঝিকোড় সিটি ক্রাইম ব্রাঞ্চের সহকারী কমিশনার অনিল শ্রীনিবাসন সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, নজরদারি এড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয় ‘ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল’ (ভিওআইপি)। এক সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, কোঝিকোডে অবৈধ এক্সচেঞ্জের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্তরা ভিওআইপি পদ্ধতিতে কল করার জন্য একটি সংস্থার নামে বিদেশি সার্ভার ব্যবহার করছে। যাঁরা এই সার্ভারটি কিনেছেন, তাঁদের শনাক্ত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এই ভিওআইপির মাধ্যমে অনেক কম খরচে ব্যবহারকারীদের পরিষেবা দেওয়া যায়। অবৈধ এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে যাওয়া কলগুলি সহজে শনাক্তও করা যায় না। এই র্যাকেটগুলির অবৈধ কার্যকলাপ দিনের পর দিন বাড়তেই থাকে।
কী ভাবে কাজ করে এই সব সংস্থা। মোবাইল ফোন থেকে একটি আন্তর্জাতিক কলকে ভিওআইপিতে রূপান্তরিত করা হয়। তার পর সিম বক্সের মাধ্যমে ভিওআইপিকে আবার স্থানীয় কলে রূপান্তর করা হয়।
চিনের বাজারে এই সিম বক্সগুলি সহজে পাওয়া যায়। এই সিম বক্সগুলিতে ৩২টি পর্যন্ত সিম কার্ড থাকতে পারে৷ ফোন কলগুলি এর মধ্যে দিয়েই কড়া নজরদারি এড়িয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, দুবাইয়ের এক ব্যক্তি কেরলে ফোন করলে, সেই ফোন কলটি কেরলের একটি স্থানীয় নম্বরে পরিণত হয়।
কল প্রাপকের কাছে একটি স্থানীয় নম্বর থেকেই ফোন আসে। এর ফলে, আন্তর্জাতিক শুল্কের বাড়তি খরচের হাত থেকে বাঁচা যায়। অবৈধ অপারেটরগুলি প্রকৃত শুল্কের মাত্র ৫০ শতাংশ কম খরচে কাজ করে।
এই সব সংস্থা বৈধ টেলিকম বিভাগের অপারেটরদের ব্যবসার ক্ষতি করে। এর ফলে সরকারও বড় অঙ্কের কর থেকে বঞ্চিত হয়। এফটিআই কনসাল্টিং স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন সংস্থার কর্মী প্রশান্ত কে রায় সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, আরব থেকে কেরলে একটি কল পিছু প্রতি মিনিটে ৮ থেকে ৯ টাকা পর্যন্ত ধার্য করা হয়। কিন্তু অবৈধ পদ্ধতিতে তার চেয়েও খরচের পরিমাণ কম।
রাজস্ব ক্ষতি ছাড়াও এর ফলে দেশের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এর মাধ্যমে ‘মাস্কিং কল’গুলি চোরাচালান বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশি সার্ভার ব্যবহার করার ফলে ব্যবহারকারীদের ধরাও কঠিন হয়ে পড়ে।
পুলিশ জানিয়েছে, রাজ্যে বেআইনি টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলি সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করে। পাশাপাশি অপরাধীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করে তোলে।