খেলনা ভেঙে চুরচুর। কিন্তু তার মাঝে পড়ে থাকা এক টুকরো ধাতব খণ্ড নিয়েও খেলা চলত। দরজার শিকল থেকে জানলার গারদ, যেখানেই সেই খণ্ড ছোঁয়ানো হয়, আটকে থেকে যায়। কী অদ্ভুত! ছোটবেলায় খেলার সময় এ ভাবেই চুম্বকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। একটু বড় হলে বইয়ের পাতা থেকে জানতে পারি চুম্বক কী। উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু কী। কিন্তু জানেন কি বিশ্বের শক্তিশালী চুম্বক কোনটা? জানেন সেই চুম্বকের ক্ষমতা? সে এমন এক চুম্বক, যার দুটো বিপরীত মেরু পরস্পরের কাছাকাছি আনলে জোড় লাগার সময় ‘খটাং’ করে আওয়াজ হয়। সেই জোড়ের সময় ভুল করে যদি মাঝখানে হাত পড়ে তবে ভাঙতে পারে হাতের হাড়ও!
বিশ্বের শক্তিশালী চুম্বকের নাম নিওডিমিয়াম। বিজ্ঞানে তার পরিচিতি নিয়ো হিসাবে। একে বলা হয় বিরল মৃত্তিকা চুম্বক। লোহা এবং বোরনের সংকর হয়ে কেলাসের মাধ্যমে গঠিত হয় এই চুম্বক। কিছু দিন আগে নিওডিমিয়াম চুম্বকের একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে।
সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামে সেই ভিডিয়ো পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে এক লক্ষের বেশি মানুষ দেখে ফেলেছেন। ভিডিয়োটি দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছেন নেটাগরিকরা। কেমন সেই সব দৃশ্য?
ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে দুটো নিওডিমিয়াম চুম্বককে ঠেলে কাছাকাছি আনতেই তারা দূর থেকেই ঝপ করে পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে। মুহূর্তের মধ্যে জোড়া লেগে যায়। সেই প্রাবল্য এমন যে আগুনের ফুলকি দেখা যায়।
দুটো নিওডিমিয়াম চুম্বকের মাঝে যদি গ্যাস লাইটার রাখা হয়, জোড় লাগার সময় আগুন বেরিয়ে যায়। একটু বড় মাপের দুটো নিওডিমিয়াম চুম্বক পরস্পরের কাছে আনলে তারা যে গতিতে জোড় লাগে, তাতে নিজেরাই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, এই চুম্বকগুলি অন্য জিনিসকেও পিষে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে যদি তারা মাঝখানে চলে আসে।
যদি দু’টি নিওডিমিয়াম চুম্বকের বিপরীত মেরু একসঙ্গে লেগে থাকে তবে তাদের মুক্ত করা প্রায় অসম্ভব।
বস্তুত, যে কোনও চুম্বকের চৌম্বক শক্তি তার আকারের উপরও নির্ভর করে। তাই কয়েক কিউবিক সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় নিওডিয়ামিয়াম চুম্বকের মধ্যে চৌম্বকীয় বল এতটাই শক্তিশালী যে, দু’টি চুম্বকের মধ্যে হাত রাখা হলে হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
নিউডিমিয়াম আদতে একটি মোলিক পদার্থ। ১৮৮৫ সালে এটি আবিষ্কৃত হয়। মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যা ৬০। রূপোলি, সাদা ধাতব বর্ণের মৌলটি পর্যায় সারণির ল্যানথানাইড দলের বিরল মৃত্তিকা মৌল সমূহের উপদলের অন্তর্ভুক্ত। এটি বাতাসে দ্রুত জারিত হয়।
প্রকৃতিতে কিন্তু নিওডিমিয়াম বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ল্যান্থানাইড মৌলের আকরিকের সঙ্গে এদের পাওয়া যায়। এর প্রাচুর্য তামার মতো হলেও নিষ্কাশন এবং শোধন প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠিন।
মূলত ব্রাজিল, চিন, আমেরিকা, শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু জায়গায় নিওডিমিয়াম পাওয়া যায়। আশির দশকে জেনারেল মোটর্স এবং হিতাচি নিওডিমিয়াম-লোহা-বোরন চুম্বক প্রস্তুত করত। খুব কম পরিমাণ নিওডিমিয়ামের চুম্বক অত্যন্ত উচ্চ চৌম্বক শক্তি সরবরাহ করতে পারে। সে জন্যই এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এখন বিশ্বের শক্তিশালী চুম্বকের ব্যবহার আরও বহুল হয়েছে। হার্ড ডিস্ক, মোবাইল, টিভি এবং মিউজ়িক সিস্টেমের যন্ত্রাংশ তৈরিতে নিওডিমিয়ামের ব্যবহার ব্যাপক ভাবে বেড়েছে।
একটি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী চুম্বকের বাৎসরিক ব্যবহার ১৯৮৩ সালে ১ টন থেকে ২০০৭ সালে ৬০ হাজার টনে পৌঁছে গিয়েছিল।
নিওডিয়ামিয়াম, লোহা এবং বোরন খাদকে একটি সিলিন্ডারে রাখা হলে সেটি হয়ে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী চুম্বক।
সমস্ত শক্তিশালী জিনিস বা বস্তুরই কিছু দুর্বলতা আছে। বিশ্বের শক্তিশালী চুম্বকও সেই নিয়মের বাইরে নেই। নিওডিমিয়াম চুম্বকের দুর্বলতা হল, আগুনের সংস্পর্শে নিয়ে এলে এর সমস্ত চৌম্বক শক্তি হারিয়ে যায়। আগুনে পোড়ালে বিশ্বের শক্তিশালী চুম্বক একটি সাধারণ ধাতুতে পরিণত হয়।