জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক দশকে কখনও এতটা অসহায় হয়নি এশিয়া। এই মহাদেশে উৎপাদিত বিদ্যুৎশক্তির তিন-চতুর্থাংশ আসে ভারত এবং চিন থেকে। তবে বিরূপ প্রকৃতির রোষে এই দু’দেশেই চিরাচরিত পথে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার দ্রুতগতিতে নিম্নমুখী হয়েছে। একই পরিস্থিতি ভিয়েতনাম-সহ এশিয়ার বহু দেশে। ফলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সঙ্কটে পড়েছে এশিয়া।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির মতো চিরাচরিত উৎসের বদলে জলবিদ্যুতের মতো বিকল্প উপায়ের উপর ভরসা করতে শুরু করেছিল ভারত এবং চিন-সহ এশিয়ার নানা দেশ। কিন্তু গত এক দশকে সে উৎসে টান পড়েছে। যার জেরে ভারত এবং চিন, দু’দেশই ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির উপর বেশি ভরসা করছে।
চিরাচরিত পথে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা এবং পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে পরিবেশের সমূহ ক্ষতি হয়। এর জেরে কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়। যা বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান কারণ।
পরিবেশ দূষণ এবং আবহাওয়ার বিরূপ পরিবর্তন রুখতে দূষণকারী জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করায় জোর দিয়েছে ভারত-সহ গোটা বিশ্ব। কয়লা, পেট্রোলিয়ামের মতো পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর উৎস থেকে তৈরি বিদ্যুৎশক্তির উৎপাদন কমাতে উদ্যোগী হয়েছে তারা। সে কারণে সৌর, বায়ু বা জলবিদ্যুতের মতো বিকল্প পথের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২১ সালে নভেম্বরে ব্রিটেনের গ্লাসগোয় রাষ্ট্রপু়ঞ্জের জলবায়ু সম্মেলনে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে প্রায় ২০০টি দেশ। গ্লাসগো সম্মেলন বা সিওপি২৬ নামে পরিচিত সেই মঞ্চে কয়লার ব্যবহার বন্ধের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।
সিওপি২৬ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, গ্রিন হাউস গ্যাসের মূল উৎস হল কয়লা। এর ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। যদিও তাতে আপত্তি জানিয়ে ভারতের দাবি ছিল, জীবাশ্ম জ্বালানি পুরোপুরি বন্ধ না করে তার পরিমাণ ধীরে ধীরে কমাতে হবে।
ভারত এবং চিন, দু’দেশই গত এক দশকে আবহাওয়ার চরম রূপ দেখেছে। এ ছাড়া, সাম্প্রতিক কালে উত্তর চিনের এক বিশাল অংশ, ভিয়েতনাম এবং উত্তর ও পূর্ব ভারত জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অঞ্চলগুলিতে প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে।
এ সবের জেরেই অপ্রচলিত শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে কয়লা, পেট্রোলিয়ামের মতো ক্ষতিকারক জীবাশ্ম জ্বালানির উপরে ভরসা করতে হচ্ছে ভারত-চিনকে।
বিদ্যুৎশক্তির ক্ষেত্রে খ্যাতনামা থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘এম্ব্যার’-এর পরিসংখ্যান জানিয়েছে, এশিয়া জুড়ে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুতের জোগানে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমেনি। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এশিয়ায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন নিম্নমুখী হয়েছে ১৭ শতাংশ।
অন্য দিকে, জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে এশিয়ায় বিদ্যুৎশক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৫ শতাংশ। ‘রিসট্যাড এনার্জি’-র ডিরেক্টর কার্লোস তোরেস ডিয়াজ় বলেন, ‘‘এশিয়ায় সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তি চালিত বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তা সত্ত্বেও চলতি বছরে জীবাশ্ম জ্বালানির সাহায্যে উৎপাদিত বিদ্যুতের সরবরাহ বেড়েছে। এর জেরে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন নিম্নমুখী হয়েছে।’’
প্রাকৃতিক কারণে অপ্রচলিত উৎসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাধাবিপত্তি তৈরি হয়েছে। ডিয়াজ় আরও বলেন, ‘‘দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহের জেরে এশীয় অঞ্চলের সংরক্ষিত জলস্তর নেমে গিয়েছে। চাহিদা মেটাতে বিদ্যুতের বিকল্প উৎসের প্রয়োজন।’’
চিনের ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিক্স’-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গোড়া থেকে অগস্ট পর্যন্ত সে দেশে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫.৯ শতাংশ কম হয়েছে। যা ১৯৮৯ সাল থেকে সবচেয়ে কম।
চিনের মতো এ দেশেরও প্রায় একই হাল। সরকারি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে ৬.২ শতাংশ। যা ২০১৬ সালের পর থেকে সবচেয়ে খারাপ।
সরকারি তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, এ দেশে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের হার ৯.২ শতাংশ কম হয়েছে। যা গত ১৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে দু’দেশই জীবাশ্ম জ্বালানিতে ঝুঁকেছে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে গত অগস্ট পর্যন্ত চিনে জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৬.১ শতাংশ। ভারতের ক্ষেত্রে তা ১২.৪ শতাংশ।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অগস্ট পর্যন্ত চিনে পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতে যা ১৮ শতাংশ বেড়েছে।
ভারত-চিন ছাড়া ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স অথবা মালয়েশিয়ার মতো এশিয়ার অন্যান্য দেশেও জলবিদ্যুতের অবস্থা প্রায় একই। মূলত শুষ্ক আবহাওয়ার কারণেই এই হাল বলে মনে করছেন ‘এম্ব্যার’-এর বিশেষজ্ঞরা।
‘এম্ব্যার’-এর পরিসংখ্যান অনুযারী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ভিয়েতনামে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের হার ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। তবে কয়লার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় ওই শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অন ক্লিন এনার্জি অ্যান্ড এয়ার’-র মুখ্য বিশ্লেষক লরি মাইলিভির্টা জানিয়েছেন, চিনে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমস্ত বাঁধ কর্তৃপক্ষকে জলস্তরের মাত্রা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে সে দেশের প্রশাসন।
‘এম্ব্যার’ জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এশিয়ায় বায়ু এবং সৌরচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছর আগেকার ১১.৫ শতাংশের তুলনায় চলতি বছর যা ১৩.৫ শতাংশ ঊর্ধ্বমুখী।
যদিও জলবিদ্যুতের তুলনায় বায়ুশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা বা তার পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, স্থানীয় এলাকায় আবহাওয়ার নানা পরিস্থিতির উপর তা নির্ভর করে।
ভারত সরকারের দাবি, চাহিদা সত্ত্বেও চলতি বছর দেশে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট শূন্যে নামিয়ে আনা গিয়েছে। কারণ দীর্ঘ দিন ধরে অপ্রচলিত শক্তির ভান্ডার তৈরি করেছে ভারত। তা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিদেশ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করতে হয়েছে।