গ্রিসের থেসালি অঞ্চলের মেটেওরা। সেখানেই রয়েছে প্রাচীন থিওপেট্রা গুহা। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, এই গুহায় হাজার বছর আগে মানুষ বাস করত। তবে সম্প্রতি এই গুহার রেডিয়োকার্বন নমুনা পরীক্ষার ফল দেখে চমকে গিয়েছেন গবেষকেরা। এই গুহাতেই মিলেছে মানুষের তৈরি প্রাচীনতম পরিকাঠামো।
মেটেওরার গুহার রেডিয়োকার্বন নমুনার ফল বলছে, ৫০ হাজার বছর আগেও এই গুহায় ছিল মানুষের বাস। এমনকি এক লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগেও গুহায় মানুষের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে।
শুধু তাই নয়, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা জেনেছেন, মধ্য প্রস্তর যুগ থেকে নব্য প্রস্তর যুগ পর্যন্ত টানা এই গুহায় ছিল মানুষের বাস। এই আবিষ্কারের ফলে নিত্যনতুন বহু তথ্যও উঠে এসেছে গবেষকদের হাতে। গ্রিসের অতীত যুগের ছবি আরও স্পষ্ট হয়েছে।
থিওপেট্রা গুহা খননের পর সেখান থেকে মিলেছে সমাধি, পাথরের তৈরি অস্ত্র, বাসন, পশুর হাড়। মানুষের তৈরি কিছু পরিকাঠামোও মিলেছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনতম বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, নিয়ান্ডারথাল (আদিম মানব) প্রজাতির মানুষের বাস ছিল এই থিওপেট্রা গুহায়। আজকের মানুষের থেকে অনেকটাই অন্য রকম ছিল নিয়ান্ডারথাল। তাদের ভুরুর জায়গা ছিল অনেকটাই উচু। নাক প্রসারিত। মনে করা হয়, প্রায় চার লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুকে তাদের বাস ছিল।
থিওপেট্রার রেডিয়োকার্বন পরীক্ষার পর গবেষকরা মনে করছেন, এটি মানুষের তৈরি পৃথিবীর প্রাচীনতম গুহা। তবে নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির মানুষ পাহাড় কেটে এই গুহা তৈরি করেনি। তারা সম্ভবত ছোট একটি অংশে বসবাস শুরু করে। পরবর্তী কালে আধুনিক মানুষেরা পাহাড় কেটে কেটে এই গুহার বিস্তৃতি বৃদ্ধি করেছে।
মেটেওরায় চুনাপাথরের তৈরি পাহাড়ের উত্তর-পূর্ব ঢালে রয়েছে এই গুহা। পাহাড়টির উচ্চতা ১০০ মিটার। প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে তৈরি হয়েছিল পাহাড়টি।
এই গুহার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে দেখা যায় লেথাইওস নদী, উপত্যকা, থিওপেট্রা গ্রাম। দৃশ্যটি বেশ মনোরম।
প্রায় ৫০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত আদিম এই গুহা। গুহার প্রবেশপথ বিশাল চওড়া। তাই গুহার ভিতর অনেক দূর পর্যন্ত আলো প্রবেশ করতে পারে। ঠিক সে কারণেই এই গুহায় লক্ষ বছর আগে বাস করতে শুরু করেছিল মানুষ।
১৯৮৭ সালে এই গুহার খননের কাজ শুরু হয়। চলে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। এর পর এই গুহা থেকে উদ্ধার হয় গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সামগ্রী। খুলে যায় অতীতের একের পর এক দরজা।
স্থানীয় পশুচারণকারীরা পশুদের অস্থায়ী আশ্রয় হিসাবে এই থিওপেট্রা গুহাকে ব্যবহার করতেন। মাঝেমধ্যেই গুহায় ভেড়া, গরু বেঁধে রেখে বাড়ি চলে যেতেন তাঁরা। সে ভাবেই প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিকদের নজরে আসে গুহাটি। তার পর শুরু হয় খননকাজ।
খনন করতে গিয়েই ইতিহাসবিদেরা জানতে পারেন, এই গুহায় প্রায় লক্ষ বছর আগেও বাস করত মানুষ। যুগের পর যুগ এখানেই ঘর-সংসার করেছে তারা। ক্রমে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পরিত্যক্ত হয় গুহাটি।
গুহার প্রত্নতাত্ত্বিক স্তর পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, জলবায়ুর অনেক পরিবর্তন সয়েছে এই গুহা। এক সময় ছিল প্রবল গরম। তার পর এক সময় ছিল প্রবল ঠান্ডা। এ সব কারণেই গুহার জনসংখ্যা কমেছে। বাসের অযোগ্য হয়েছে।
এই গুহা থেকেই মিলেছে মানুষের তৈরি প্রাচীনতম পরিকাঠামো— একটি পাথরের প্রাচীর। গ্রিসে তো বটেই, গোটা পৃথিবীতেও সম্ভবত এটিই প্রাচীনতম। আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গিয়েছে, এই প্রাচীর ২৩ হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, গুহার প্রবেশপথ আড়াল করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল সেই প্রাচীর। সেই প্রাচীরের অনেকটা অংশ ভেঙে গিয়েছে।
এই গুহার নরম মাটির মেঝে থেকে তিনটি পায়ের ছাপও উদ্ধার হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা জানিয়েছেন, এগুলি নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির শিশুদের। এই পায়ের ছাপ যাদের, তাদের বয়স দুই থেকে চার বছরের মধ্যে ছিল। মধ্য প্রস্তর যুগে এই গুহায় বাস করত তারা।
২০০৯ সালে এই গুহা দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। যদিও এক বছর পর যখন ওই প্রাচীনতম প্রাচীর আবিষ্কার হয়, তখন গুহা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে আবার এখানে প্রবেশ করতে পারতেন দর্শক। যদিও ধস নামার আশঙ্কায় তা ২০১৬ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন আবার এই গুহায় প্রবেশের অধিকার রয়েছে দর্শকদের।