কথায় আছে ওস্তাদের মার শেষ রাতে। টানটান উত্তেজনা, দেশবাসীর প্রার্থনা এবং সম্মিলিত আবেগ, কোনওটাই বিফলে যায়নি। অবশেষে দীর্ঘ ১৭ বছর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত। ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ রানে হারিয়ে আবার নতুন করে ট্রফির স্বাদ পেলেন রোহিত শর্মারা। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বিপ্লব ঘটাল ভারতীয় ক্রিকেট দল। নিমেষে পাল্টে গেল মাঠের পরিবেশ। সাক্ষী থাকল ১৩৩ কোটি দেশবাসী। তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস।
এক দিকে যখন বিশ্বকাপ জিতে উল্লসিত ভারতীয় দল, ঠিক তখনই দক্ষিণ আফ্রিকার শিবিরে নেমে আসে হতাশার কালো মেঘ। অধরা থেকে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।
ম্যাচ শেষ হওয়ার পর কেঁদে ফেললেন ভারতীয় দলের সকলে। স্টেডিয়ামে উপস্থিত ভারতীয় সমর্থকদের চোখেও ছিল আনন্দাশ্রু। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভারতীয় ভক্তরাও তাঁদের উত্তেজনা সামলাতে পারেননি। নিজেদের মতো করে মেতে উঠলেন এই উৎসবে।
২০১১ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দলের এক দিনের বিশ্বকাপ জয়ের পর একাধিক বার ফাইনালে বা সেমিফাইনালে উঠলেও শেষ হাসি হাসতে ব্যর্থ হয় ভারত। ২০২৩ সালে এক দিনের বিশ্বকাপে ভারত ফাইনালে উঠলেও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পরাজিত হয় তারা। ভারতের মাটিতেই মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন রোহিতেরা। অবশেষে ১৩ বছর পর, ট্রফি জয়ের খরা কেটেছে।
শনিবার ফাইনালে আনরিখ নোখিয়ের ব্যাট থেকে বল বেরিয়ে মিড উইকেটে যেতেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছিলেন হার্দিক পাণ্ড্য। মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়েছিলেন রোহিত শর্মা। কাঁদছিলেন ঋষভ পন্থ, যশপ্রীত বুমরা, সূর্যকুমার যাদবেরা। এমনকি, বেঞ্চে বসে থাকা মহম্মদ সিরাজও কাঁদছিলেন। শনিবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গোটা ভারতীয় দল কাঁদছিল। কেউই নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারছিলেন না।
হার্দিক পাণ্ড্যর হাত ধরে হারের মুখ থেকে জয় ছিনিয়ে নিলেন রোহিতেরা। বাউন্ডারি লাইনে ডেভিড মিলারের দুর্দান্ত ক্যাচ ধরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারের দরজা দেখিয়ে দেন সূর্যকুমার যাদবও। শেষ তিন ওভারে ম্যাচের রং সম্পূর্ণ বদলে যায়। রোহিতদের হার না মানা মানসিকতার সামনেই স্বপ্নভঙ্গ হল দক্ষিণ আফ্রিকার।
ফাইনাল জেতার পরে আবারও হার্দিক পাণ্ড্যের চোখের জল বুঝিয়ে দিল, কতটা স্বস্তি পেয়েছেন তিনি। এর আগে, ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এ বারও, আবেগ ধরে রাখতে পারেননি হার্দিক। হাউ হাউ করে কেঁদেছেন, কখনও আবার সতীর্থদের জড়িয়ে ধরেছেন। তার পরে হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠে ঘুরতেও দেখা যায় হার্দিককে। সময় কঠিন এলেও নিজেদের উপর বিশ্বাস হারাননি তিনি। গত ৬ মাস ধরে এই দিনটারই অপেক্ষা করছিলেন তিনি।
মাঠে খোশমেজাজে দেখা গিয়েছিল কোচ রাহুল দ্রাবিড়কেও। কোচ হিসাবে এই প্রথম বিশ্বকাপ জিতলেন তিনি। ভারত জিততেই মাঠে নেমে পড়লেন রাহুল। বিশ্বসেরা হয়ে নিজের কোচিং কেরিয়ার শেষ করলেন তিনি।
ভারতীয় দলকে মাঠে ভাঙড়া নাচতেও দেখা যায়। প্রাণ ভরে তাঁরা জয়টিকে উপভোগ করেন।
মাঠে নেমে ক্রিকেটারদের জড়িয়ে ধরলেন সাপোর্ট স্টাফেরাও। কেউ তখন কাউকে সামলাতে পারছেন না। বলা ভাল কেউ কাউকে সামলাতে চাইছেন না। জেতার আনন্দে উদ্বেল তাঁরা। দেখা গেল হার্দিককে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন রোহিত।
কিছু ক্ষণ পরে আবার দেখা গেল, রোহিত ও বিরাট একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন। বার বার ব্যর্থতা দেখেছেন তাঁরা। সেই কারণে এ বার জয়ের আনন্দও ভাগ করে নিচ্ছেন তাঁরা।
পুরো প্রতিযোগিতায় নজর কাড়তে না পারলেও, ফাইনালে আগ্রাসী মেজাজেই কোহলিকে খেলতে দেখা গিয়েছিল । অনেক দিন পর এ দিন চেনা মেজাজে খেলছিলেন তিনি। কিন্তু চাপের মুখে নিজেকে গুটিয়ে নেন কোহলি। প্রতিযোগিতার প্রথম অর্ধশতরান করলেন তিনি। আউট হলেন ৫৯ বলে ৭৬ রান করে। তাঁর ব্যাট থেকে এল ৬টি চার এবং ২টি ছক্কা।
মাঠে নেমে পড়লেন ক্রিকেটারদের পরিবারের সদস্যরাও। রোহিত গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর স্ত্রী রীতিকাকে। বুমরাকে জড়িয়ে স্ত্রী সঞ্জনা। বিরাট আবার ভিডিয়ো কলে কথা বললেন স্ত্রী অনুষ্কা শর্মা ও সন্তানদের সঙ্গে।
অন্য দিকে, হার্দিককে মাঠে দেখা গেল জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরতে। সিরাজের চোখের জল মোছানো যাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতেই কথা বলছেন তাঁরা।
ভারত যে মাঠেই খেলুক না কেন, দর্শকেরা গ্যালারি ভরিয়েছেন। তাঁদের উদ্দেশে গোটা মাঠ প্রদক্ষিণ করলেন ভারতীয় দল। খোশমেজাজে পুরো মাঠ ঘুরলেন তাঁরা।
বিশ্বকাপ জিতে নিজেদের মনের কথা তুলে ধরলেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা। সঞ্চালককে জানালেন, বিশ্বসেরা হয়ে কেমন অনুভূতি হচ্ছে তাঁদের।
দীর্ঘ অপেক্ষার পরে অবশেষে সেই দিনটি এল, যার জন্য এত দিন ধরে সবাই অপেক্ষা করেছিলেন। ট্রফি হাতে আবারও চেনা ছন্দে দেখা গেল ভারতীয় দলকে। সকলেই এক বার করে ট্রফিটি হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন। উপভোগ করলেন এক সুন্দর মুহূর্ত।
মধ্যরাতে গোটা দেশ উৎসবে মাতোয়ারা। ভারত ফাইনাল জেতার পরেই চারিদিক থেকে বাজি ফাটানোর শব্দ ভেসে ওঠে। নাচে, গানে, আনন্দে আত্মহারা ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তেরা। ফাইনাল বার্বাডোজ়ের ব্রিজটাউনে হলেও তার রেশ দেখা গিয়েছে ভারতের বিভিন্ন শহরে। ভারতের পতাকা নিয়ে রাস্তায় দেখা যায় মানুষের ঢল। একে অপরকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করতেও দেখা যায়।
এক দিকে যখন বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতে আনন্দে আত্মহারা গোটা ভারতীয় দল, অন্য দিকে ম্যাচের সেরার পুরস্কার নিতে এসে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে অবসরের কথা ঘোষণা করেন বিরাট কোহলি। পাশাপাশি, সাংবাদিক বৈঠকে অবসর ঘোষণা করে দিলেন রোহিত শর্মাও। তিনি জানিয়ে দিলেন, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে তিনি অবসর নিচ্ছেন। তাই এই উল্লাস, আনন্দের মাঝেই ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে দেখা গেল সামান্য দুঃখের ছায়া।
শনিবার রাতে ভারতীয় সাজঘর সাক্ষী থাকল এক মিশ্র অনুভূতির। হাসি, কান্না, জয়, অবসরে ডুবে থাকল ভারতীয় দলের প্রত্যেক সদস্য। পাশাপাশি, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আপামর ভারতীয়দের মনের মণিকোঠায় থেকে গেল বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিটি মুহূর্ত।