গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বিজ্ঞপ্তি জারি করে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাজার থেকে সমস্ত দু’হাজার টাকার নোট তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)। পাশাপাশি এ-ও জানানো হয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের পরেও ২০০০ টাকার নোট ‘অবৈধ’ হয়ে যাবে না। যদিও আরবিআইয়ের তরফে এই বিষয়ে আর কিছু জানানো হয়নি।
আরবিআইয়ের এই ঘোষণার পর দেশ জুড়ে ২০০০ টাকার নোট বদলানোর হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। ২০০০ টাকার নোট বদলাতে পেট্রল পাম্প থেকে শুরু করে শপিং মল, বিভিন্ন জায়গায় ভিড় জমাতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। শুধু বাদ থাকছে ব্যাঙ্ক!
ব্যাঙ্কে জমা করার ঝক্কি এড়াতে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, এমনকি বিলাসবহুল পণ্যসামগ্রী কেনার দিকেও মন দিয়েছে আমজনতা। অনেক ক্ষেত্রেই টাকার লেনদেন নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। অনেক দোকানদারই আরবিআইয়ের ঘোষণার পর থেকে ২০০০ টাকার নোট গ্রহণ করতে সরাসরি অস্বীকার করছেন।
তা হলে কী ভাবে ২০০০ টাকার নোট কী ভাবে খরচ করছেন সাধারণ মানুষ? কী ভাবে বা সেই নোট ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন?
দেশের অনেক ব্যবসায়ী দু’হাজার টাকার নোট গ্রহণ করতে না চাইলেও অনেকে আবার এই পরিস্থিতিকে ব্যবসা বৃদ্ধির উপায় হিসাবেই দেখছেন।
ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেট এলাকার আম বিক্রেতা মহম্মদ আজহার বলেন, ‘‘শনিবার থেকে আমের বিক্রি বেড়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ মানুষই দু’হাজারের নোট নিয়ে আম কিনতে আসছেন। একসঙ্গে অনেক আম কিনে ফিরছেন।’’
মহম্মদ আরও বলেন, “শনিবার থেকে প্রতি দিন কমপক্ষে ৮-১০টা দু’হাজারের নোট পাচ্ছি। আমি কোনও রকম আপত্তি না করেই নোটগুলি নিয়ে নিচ্ছি। আমাদের কোনও উপায় নেই। এটাই আমার ব্যবসা। ৩০ সেপ্টেম্বরের আগে একবারে সব নোট ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেব। নোট অবৈধ ঘোষণা হওয়ায় কোনও ভয় নেই।” একই চিত্র দেশের অন্য বড় শহরগুলিতেও।
মধ্য মুম্বইয়ের একটি শপিং মলের বিলাসবহুল ঘড়ির দোকানের ম্যানেজার মাইকেল মার্টিস জানিয়েছেন, দু’হাজারের নোট বাজার থেকে তুলে নেওয়ার ঘোষণার পর থেকে তাঁর দোকানে বিক্রি বেড়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ মানুষই নগদে ঘড়ি কিনছেন। যার মধ্যে দু’হাজার টাকার নোটই বেশি।
মাইকেল বলেন, ‘‘আগে দিনে আমাদের দু’তিনটি ঘড়ি বিক্রি হত। এখন সেই ঘড়ি বিক্রি বেড়ে ৪-৫টি হয়ে গিয়েছে।’’
এক পরিচিত খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থা টুইটারে লিখেছে, ‘‘শুক্রবার থেকে অনলাইনের বদলে নগদ দিয়ে (ক্যাশ অন ডেলিভারি) খাবার আনানো বেড়েছে। অন্তত ৭২ শতাংশ ক্রেতা দু’হাজার টাকার নোট দিচ্ছেন ডেলিভারি বয়দের।’’
যদিও সংস্থার মুখপাত্র পরে জানান, টুইটটি ঠাট্টা করে করা হলেও অ্যাপের মাধ্যমে খাবার আনিয়ে ডেলিভারি বয়দের হাতে দু’হাজার টাকার নোট ধরানোর সংখ্যা বেড়েছে। তবে তা আসলে কত বেড়েছে তা তিনি স্পষ্ট করেননি।
অনেকে আবার নামীদামি রেস্তোরাঁয় খেয়ে এবং দামি পোশাক কিনেও দু’হাজারের নোট খরচ করছেন। এমনটাই দাবি রেস্তোরাঁ এবং কাপড়ের দোকানের মালিকদের একাংশের। ভিড় বাড়ছে পেট্রল পাম্পের বাইরেও।
তবে সব দোকানের মালিক দু’হাজার টাকার নোট নিতে রাজি নন। দক্ষিণ মুম্বইয়ের এক রেস্তোরাঁর মালিকের কথায়, “আমি কোনও ভাবেই দু’হাজার টাকার নোট গ্রহণ করব না। আমি ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দেওয়ার ঝামেলায় পড়তে চাই না।”
২০১৬ সালে ১০০০ এবং ৫০০ টাকার নোটবন্দির কথা ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র। তার পর থেকে ব্যাঙ্কে পুরনো নোট বদলে নতুন নোট পাওয়ার তাগিদে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল।
২০২৩-এর চিত্র একেবারেই আলাদা। দু’হাজার নোট তুলে নেওয়ার ঘোষণার পর থেকে কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, দিল্লির মতো বড় শহরগুলির ব্যাঙ্কের বাইরে মুষ্টিমেয় মানুষের ভিড়। কারও মধ্যেই নোট বদলানোর সে রকম আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
শহরের তুলনায় মফস্সল এবং গ্রামাঞ্চলে নোট বদলানোর ভিড় বেশি। তার মধ্যেও তুলনায় বেশি ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে ‘স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই)’-র বাইরে।
২০১৬ সালের নোটবন্দির কথা মাথায় রয়েছে সাধারণ মানুষের। দেশ জুড়ে বিশৃঙ্খলার ছবি ফুটে উঠেছিল ব্যাঙ্কগুলির লাইনে। দীর্ঘ ক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোগান্তির কথাও সাধারণের স্মৃতি থেকে মোছেনি।
পাশাপাশি, একসঙ্গে অনেক দু’হাজারের টাকা ব্যাঙ্কে জমা করতে গেলে আয়কর বিভাগের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয় কাজ করছে অনেকের মনে! সেই আশঙ্কা থেকেও অনেকে ব্যাঙ্কে যাওয়া এড়াচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
একই সঙ্গে আরবিআইয়ের তরফে ২০০০ টাকার নোট‘বন্দি’ না করার কারণেও নাকি ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়াতে চাইছেন না আমজনতা।
প্রসঙ্গত, আগামী বছর দেশের লোকসভা নির্বাচন। সামনেই বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের দাবি, এই সময় দেশ জুড়ে বেআইনি লেনদেনের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়। তাই তার আগে আরবিআইয়ের এই সিদ্ধান্ত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে।