ভারত-মলদ্বীপ নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের জেরে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমের সেই দ্বীপরাষ্ট্রকে বয়কটের ডাক দিয়েছেন দেশের বহু মানুষ। ভ্রমণপ্রিয় দেশবাসীর নজরে এখন ভারতেরই একটি দ্বীপপুঞ্জ— লক্ষদ্বীপ।
ঝিকিমিকি লেগুন, সাদা বালির নির্জন সৈকত এবং প্রচুর প্রবাল— লক্ষদ্বীপ এবং মলদ্বীপের মধ্যে মিল প্রচুর। লক্ষদ্বীপের পুরনো সৈকতগুলি সাদা বালি এবং স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জলের জন্য বিখ্যাত।
সম্প্রতি লক্ষদ্বীপ সফরে গিয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লক্ষদ্বীপের সমুদ্রে প্রধানমন্ত্রী মোদীর স্নর্কেলিং (এক ধরনের জলক্রীড়া) করা, সাদা বালির উপর ভ্রমণ বা বিশাল নীল সৈকতে বিশ্রাম নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসার দিনই ৫০ হাজার মানুষ লক্ষদ্বীপ নিয়ে গুগ্লে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। ফলে মনে করা হচ্ছে, চলতি বছর থেকে ভিড় বাড়বে লক্ষদ্বীপের সমুদ্রসৈকতে।
কিন্তু দেশবাসীর মনে লক্ষদ্বীপ যাওয়ার বাসনা তৈরি হলেও সেখানে যেতে কত খরচা হতে পারে, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক লক্ষদ্বীপ যেতে কত গাঁটের কড়ি খরচা হতে পারে।
বিভিন্ন ওয়েবসাইটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোটামুটি এক মাস আগে থেকে বিমানের টিকিট কাটলে যাওয়া-আসা মিলিয়ে এক জনের খরচ হবে ১২ হাজার টাকার কিছু বেশি।
লক্ষদ্বীপে যে ছোট-বড় রিসর্টগুলি আছে, সেখানে থাকার জন্যও অগ্রিম বুকিং থাকা অত্যাবশ্যক। কেমন কামরায় থাকছেন, তার উপর নির্ভর করে রিসর্টগুলিতে থাকতে প্রতিদিন খরচা হবে দুই থেকে সাত হাজার টাকা। তবে এর থেকে দামি ভিলা বা রিসর্ট লক্ষদ্বীপে রয়েছে। যার খরচ আরও বেশি।
লক্ষদ্বীপে এক দিনের খাওয়ার খরচ মাথা পিছু মোটামুটি ৩০০-৪০০ টাকা। তবে কী রকম খাবার খাচ্ছেন, তার উপর নির্ভর করে টাকার অঙ্কও বদলাবে।
লক্ষদ্বীপে যে দর্শনীয় স্থানগুলি রয়েছে, সেগুলি ঘুরে দেখতে প্রতিদিন খরচ পড়বে গড়ে দেড়-দু’হাজার টাকা।
এ ছাড়া কেনাকাটা তো রয়েইছে। সুতরাং, লক্ষদ্বীপে এক দম্পতির সারাদিনের গড় খরচ হবে মোটামুটি সাত-সাড়ে সাত হাজার টাকা। যা মালদ্বীপের তুলনায় বেশ কম।
তবে লক্ষদ্বীপে ঘুরতে গেলে কয়েকটি কথা মাথায় রাখতে হবে পর্যটকদের। লক্ষদ্বীপ ৩৬টি দ্বীপের সমন্বয়ে তৈরি হলেও এর মধ্যে কাভারত্তি, আগত্তি, বাঙ্গারাম, কদমত এবং মিনিকয়—এই পাঁচটি দ্বীপেই ভ্রমণ করার অনুমতি রয়েছে পর্যটকদের।
লক্ষদ্বীপের পর্যটন বিভাগের সরকারি ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কেন্দ্রশাসিত দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। তবেই সেখানে যাওয়ার অনুমতি মেলে। লক্ষদ্বীপের দ্বীপগুলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বহু আদিবাসী উপজাতিদের বাস। তাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার কথা মাথায় রেখেই সব দ্বীপে পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না।
লক্ষদ্বীপে প্রবেশের অনুমতিপত্রের ফর্ম অনলাইনে পাওয়া যায়। সেই ফর্ম জমা দিতে হয় প্রশাসনের কাছে। সেই ফর্ম খতিয়ে দেখে প্রবেশের জন্য সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়।
লক্ষদ্বীপে প্রবেশের অনুমতি পাঠানো হয় ইমেল মারফত। কোন পর্যটক ক’দিন দ্বীপপুঞ্জে কাটাবেন এবং তিনি কোন দেশের বাসিন্দা, তার উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্যও নেওয়া হয়। প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার পরেই হোটেল এবং বিমানের টিকিট বুক করতে পারেন পর্যটকেরা। লক্ষদ্বীপে সাধারণত ৩০ দিনের বেশি থাকার অনুমতি দেওয়া হয় না।
অন্য দিকে, মলদ্বীপে যাওয়ার খরচ বিপুল। মলদ্বীপে যাতায়াত করতে শুধু বিমানের খরচই গড়ে ২৫-৩৫ হাজার টাকা। তবে অগ্রিম বুকিং করলে কিছু ছাড় পাওয়া যেতে পারে।
মলদ্বীপে সাধারণ মানের কোনও রিসর্ট বা গেস্ট হাউসে এক দিন থাকার খরচ ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা।
মলদ্বীপে মাথাপিছু সারা দিনের খাওয়া বাবদ খরচ হতে পারে হাজার থেকে দু’হাজার টাকা। সারা দিনে ঘোরাঘুরি এবং কেনাকাটা করতে খরচ আরও পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা।
সুতরাং, মলদ্বীপে ঘুরতে গেলে এক দম্পতির প্রতি দিন গড়ে সাড়ে সতেরো থেকে আঠারো হাজার টাকা খরচ হতে পারে।
লক্ষদ্বীপে যাওয়ার অনুমতিপত্র নিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হলেও মলদ্বীপে যাওয়ার তেমন কোনও ঝামেলা নেই। মলদ্বীপ যেতে ভারতীয়দের ভিসা পর্যন্ত লাগে না। পকেটে টাকা থাকলেই কেল্লা ফতে!
তবে ভারতের সঙ্গে বিতর্কে জড়ানোর পর থেকে মলদ্বীপে ভারতীয় পর্যটকদের আনাগোনা কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। যে দ্বীপরাষ্ট্র এত দিন ভারতীয়দের ভ্রমণের স্বপ্নরাজ্য ছিল, সেই মলদ্বীপকে বয়কটের ডাকও দিচ্ছেন ভারতীয়েরা।
‘বয়কট মলদ্বীপ’-এর আওয়াজ তুলেছেন, ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ থেকে শুরু করে ক্রিকেট মহলের তাবড় তারকা। যে তারকারা ছুটি কাটাতে মলদ্বীপে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন, তাঁরাও মলদ্বীপ সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। মলদ্বীপ না গিয়ে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জগুলিতে ছুটি কাটানোর আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
প্রসঙ্গত, ভারত-মলদ্বীপ বিতর্কের সূত্রপাত প্রধানমন্ত্রীর লক্ষদ্বীপ সফরের পর থেকে। প্রশাসনিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কেন্দ্রশাসিত দ্বীপঅঞ্চলের সমুদ্রসৈকতেও অনেকটা সময় কাটিয়ে আসেন মোদী। ফিরে এসে সেই সফরের স্মৃতিচারণাও করেন। সফরে কাটানো মুহূর্তের প্রচুর ছবিও তিনি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন।
এর পরেই প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতকে নিয়ে কুমন্তব্য করেন মলদ্বীপ সরকারের তিন মন্ত্রী। অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী ছবিগুলি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করার পর মলদ্বীপ সরকারের তিন মন্ত্রী মরিয়ম শিউনা, মালশা শরিফ এবং মাহজ়ুম মাজিদ সেই ছবিগুলি নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ‘জোকার’ এবং ‘ইজ়রায়েলের ক্রীড়নক’ বলেও অপমান করা হয়েছে। কটাক্ষ করা হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়েও।
এর পরেই বিতর্কের মুখে পড়েন ওই তিন মন্ত্রী এবং মলদ্বীপ সরকার। বিতর্কের মুখে পড়ে নিজেদের পোস্টগুলিও মুছে ফেলেন তাঁরা। সেই সব পোস্টের ছবি (স্ক্রিনশট) সমাজমাধ্যমে ঘুরছে। যদিও সেগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। তবে চাপের মুখে ওই তিন মন্ত্রীকে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করেছে সে দেশের মহম্মদ মুইজ্জুর সরকার।
কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। বিতর্ক শুরু হতেই ভারত এবং প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন অক্ষয় কুমার, সচিন তেন্ডুলকর, সলমন খান, কঙ্গনা রানাউত, জন আব্রাহাম, শ্রদ্ধা কপূর, হার্দিক পাণ্ড্যের মতো তারকারা। মলদ্বীপ যেতে বারণ করার পাশাপাশি, দেশবাসীকে ভারতীয় দ্বীপগুলি অন্বেষণ করার বার্তাও দিয়েছেন তাঁরা।
সমাজমাধ্যমে ‘বয়কট মলদ্বীপ’-এর ঠেলা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরের উপরে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র। আগে থেকেই মলদ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার বিমান-হোটেলে টিকিট বুক করে রাখার পরেও তা বাতিল করে চলেছেন একের পর এক ভারতীয়। ক্রমে সেই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
যাঁরা বুকিং বাতিল করছেন, তাঁদের দাবি, টাকা যাচ্ছে যাক, আগে দেশ। দেশের অপমান কোনও ভাবে মেনে নেওয়া যাবে না বলেও কেউ কেউ সমাজমাধ্যমে মতপ্রকাশ করেছেন।
সেই বিতর্কের মাঝেই লক্ষদ্বীপকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে ভারত। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন হোটেল, রিসর্ট, বিমানবন্দর। পাশাপাশি, জল সমস্যা মেটাতেও তৎপর হয়েছে সরকার।