শুক্রবার কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরি গিয়েছে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর।
শিলিগুড়ির কোর্ট মোড়ের বাসিন্দা ববিতা সরকারের করা মামলার ভিত্তিতে শুক্রবার অঙ্কিতাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ তাঁকে এ যাবৎ দেওয়া সমস্ত বেতনও ফেরত দিতে হবে। দু’টি কিস্তিতে ওই টাকা ফেরাতে হবে অঙ্কিতাকে।
এসএসসি-র যে মেধাতালিকার শীর্ষে মন্ত্রীকন্যার নাম উঠেছিল, বেশি নম্বর পেয়েও সেই তালিকা থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন ববিতা। অভিযোগ ওঠে, বৈধ ভাবে নিয়োগ করা হয়নি পরেশ-কন্যাকে।
অভিযোগ, অঙ্কিতা প্রথম থেকেই জানতেন তাঁর নিয়োগ সঠিক পদ্ধতিতে হয়নি। তবুও শিক্ষকতার মতো পেশার সঙ্গে যুক্ত হতেও দুর্নীতিকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। পরেশ আগে ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ নিজের পুরনো দল ছেড়ে শাসক দলে যোগ দেন পরেশ। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে মেয়ের চাকরিই কি এই দল বদলের চুক্তির প্রধান ভিত্তি ছিল?
২০১৬ সালে স্কুলশিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছিল। মেধাতালিকা প্রকাশ হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর। সেই তালিকায় নাম ছিল না অঙ্কিতার। কিন্তু পরে, গন্ডগোল আছে জানিয়ে এই তালিকা বাতিল করে এসএসসি।
২০১৮ সালের ১৮ অগস্ট ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন পরেশ। আর তার ঠিক তিন দিন পর অর্থাৎ ২১ অগস্ট এসএসসি-র নতুন মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকার এক দম শীর্ষে নাম ছিল অঙ্কিতার নাম। তার থেকে ১৬ নম্বর বেশি পাওয়ার পরও ববিতার নাম চলে যায় ওয়েটিং লিস্টে।
প্রথম তালিকায় ববিতার নাম ছিল ২০ নম্বরে। কিন্তু অঙ্কিতার নামের উঠে আসায় এক ধাপ নেমে তাঁর ঠাঁই হয় ২১ নম্বরে।
ববিতা ছাড়া কারওরই বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না অঙ্কিতার এক নম্বরে নাম উঠে আসায়। ২৪ নভেম্বর মেখলিগঞ্জের ইন্দিরা গার্লস হাই স্কুলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিক হিসেবে যোগ দেন অঙ্কিতা।
বাড়ি থেকে স্কুল হাঁটাপথ। কাজে যোগ দেওয়ার প্রথম দিন অঙ্কিতাকে সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা পরেশ। প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীকে স্কুলে হাজির হতে দেখে শিক্ষিকা থেকে কর্মীদের একাংশ কিছুটা চমকেই উঠেছিলেন!
মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে পরেশ অধিকারী যে দিন স্কুলে গিয়েছিলেন, তখনও তিনি শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হননি।
এর কয়েক মাস পরে তৃণমূল পরেশকে কোচবিহার লোকসভার আসনের টিকিট দেয়। লোকসভায় পরেশ জিততে পারেননি। গত বছর বিধানসভায় জিতে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হন। মন্ত্রী হওয়ার পরে অবশ্য মেয়ের স্কুলে পা রাখেননি পরেশ।
২০২২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা পরিচালনায় পর্ষদের প্রতিনিধি হিসেবে মেখলিগঞ্জে দায়িত্বে ছিলেন অঙ্কিতা। মাধ্যমিক চলাকালীন বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শন করতেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
তবে শুক্রবারের হাই কোর্টের নির্দেশে আলোড়ন পড়ে যায় মেখলিগঞ্জে। স্কুলে চাপা গুঞ্জনও ছড়ায়। শিক্ষিকা-কর্মীদের মধ্যে বার্তা চালাচালিও শুরু হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রঞ্জনা রায় বসুনিয়া থাকেন জলপাইগুড়িতে। তাঁর স্বামী জলপাইগুড়ির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর দিলীপ বর্মা।
প্রধান শিক্ষিকা বলেন, “কমিশনের নির্দেশে অঙ্কিতা অধিকারী আমাদের স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন। হাই কোর্টের কোনও নির্দেশ আমরা এখনও পাইনি। এ নিয়ে আমাদের কিছু বলার থাকতে পারে না।”
ইন্দিরা গার্লসেরই প্রাক্তনী ছিলেন অঙ্কিতা। তখনও প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন রঞ্জনা। তিনি বলেন, “অঙ্কিতা ভাল ছাত্রী ছিল। বরাবরই কম কথা বলে। ও যে দিন কাজে যোগ দিতে আসে, সে দিন পরেশবাবুও সঙ্গে ছিলেন। তার পরে অবশ্য পরেশবাবু আর স্কুলে আসেননি।”
ইন্দিরা গার্লস থেকে ৭৫ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেন অঙ্কিতা। উচ্চ মাধ্যমিকেও প্রথম বিভাগে পাশ করেন বলেই স্কুল সূত্রের দাবি।
এর পর রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করেন। তার পরে বিএড ও এমএড পড়েছেন। মেখলিগঞ্জের স্কুলে শিক্ষিকা পদে যোগ দেওয়ার আগে বেশ কিছু দিন পড়িয়েছিলেন মেখলিগঞ্জের একটি বেসরকারি ডিএলএড-বিএড কলেজে। সেই কলেজের মালিকানার কিছু অংশ রয়েছে পরেশের।
বর্তমানে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন অঙ্কিতা। রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কিতা যে দিন গবেষণাপত্র জমা দিতে গিয়েছিলেন, সে দিন সর্বক্ষণ তাঁর সঙ্গী ছিলেন বাবা পরেশ।
তবে এর মাঝেই নিজের অধিকার বুঝে নিতে মন্ত্রী এবং মন্ত্রীকন্যার সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে পড়েন ববিতা। লড়াই শুরুর প্রথমে ববিতা জানতেন না পরেশ মন্ত্রী।
২০২২-এ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে মামলা করেছিলেন ববিতা। কিন্তু ‘ক্ষমতার ঝড়ে’ উড়ে যাবেন, এই ভেবে পিছিয়ে যাননি ববিতা এবং তাঁর স্বামী সঞ্জয়।
তবে এই মামলা আদালতের নির্দেশে সিবিআইয়ের হাতে পৌঁছয় এই বছরের ১৭ মে। অঙ্কিতা কী ভাবে চাকরি পেলেন, তা এর পরই খতিয়ে দেখা শুরু করে সিবিআই। পরেশকে সেই রাতেই সিবিআইয়ের সামনে হাজিরার নির্দেশও দেওয়া হয়।
হাজিরার নির্দেশে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন থেকে পদাতিক এক্সপ্রেসে ওঠেন পরেশ এবং অঙ্কিতা। কিন্তু ১৮ মে বর্ধমান স্টেশনে পরেশ-অঙ্কিতাকে শেষ দেখা যায়। এর পরই কন্যাকে নিয়ে এক প্রকার ‘ভ্যানিশ’ হন পরেশ।
এর পর বার বার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও হাজিরা না দেওয়ায় ১৯ মে পরেশের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে সিবিআই। নির্দেশ দেওয়া হয়, ওই দিনই মেয়েকে নিয়ে নিজাম প্যালেসে হাজির হতে হবে পরেশকে।
হাই কোর্টের নির্দেশে সিবিআই অফিসে পরেশ হাজির হলেও দেখা যায়নি অঙ্কিতাকে।
এর পর ২০ মে, শুক্রবার নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির কারণে হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরি যায় অঙ্কিতার।
অঙ্কিতার খোঁজে মেখলিগঞ্জের বাড়িতে গেলে নিরাপত্তা রক্ষীর মন্তব্য, “বাড়িতে কেউ নেই।”
পাশাপাশি সম্প্রতি অঙ্কিতার একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। পোস্টে লেখা ‘অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি (সততাই শ্রেষ্ঠ নীতি)’।