১৯৫০ সালের ১ মার্চ। আমেরিকার নেব্রাস্কার বিট্রিসে ওয়েস্ট সাইড ব্যাপটিস্ট গির্জায় ঘটে গিয়েছিল বিশাল বিস্ফোরণ। মৃত্যু অব্যর্থ থাকলেও কিন্তু নিজ নিজ কপাল জোরে সেই দিনে বেঁচে গিয়েছিলেন ওই গির্জায় প্রতিদিন গান করতে আসা ১৫ জন।
গির্জাতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঠিক ৭টা বেজে ২০ মিনিটে অনুশীলন করতে আসতেন কোরাস গায়কের দল। সন্ধ্যা ৭টা বেজে ১৫ মিনিটে তাঁরা গির্জায় এসে উপস্থিত হতেন। এটাই ছিল প্রতিদিনের অভ্যেস। কোনও দিনের সেই নিয়মের বদল হয়নি।
মাঝে মধ্যে এক-দু’জনের নিয়মে ব্যত্যয় দেখা দিলেও অধিকাংশ সদস্যই আসতেন ঠিক সময়ে।
১৯৫০ সালের ১ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে ওই গির্জায় গ্যাস লিক করে ওই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। বিস্ফোরণে কারণে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয় ওই গির্জা।
বিস্ফোরণের তীব্রতা এতই বেশি ছিল যে, আশপাশের বাড়িগুলির জানালা দরজা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সামনের একটি রেডিয়ো স্টেশনেরও সিগন্যাল উড়ে গিয়েছিল বিস্ফোরণের জোরে।
তবে প্রতিদিন অনুশীলনের জন্য আসা ওই কোরাস দলের কেউ এই বিস্ফোরণে নিহত হননি। কেউ সামান্য আঘাত পর্যন্ত পাননি। কারণ ‘দৈববশে’ দলের ১৫ জন সদস্যই কোনও না কোনও কারণে ওই দিন গির্জায় পৌঁছেছিলেন দেরি করে।
কোরাসের ওই দলে ছিলেন স্থানীয় মন্ত্রী রেভারেন্ড ওয়াল্টার ক্লেমপেল, তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা মেরিলিন রুথ। কোরাস অনুশীলনের জন্য পরিবারের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরনোর সময় মেরিলিন দেখেন, তাঁর পোশাকে একটি দাগ লেগেছে।
মেরিলিন কোনও দাগযুক্ত পোশাক পরে গির্জায় যেতে রাজি ছিলেন না। আর সেই জন্যই পোশাক পরিবর্তনের জন্য তিনি দৌড়ে আবার বাড়িতে ঢুকে যান। মাকে বলেন অন্য একটি জামা বার করে ইস্ত্রি করে দেওয়ার জন্য। আর সেই করতে গিয়ে তাঁদের ওই দিন গির্জায় যেতে দেরি হয়ে যায়। যখন বিস্ফোরণ হয়েছিল, তখন ওয়াল্টারের পরিবারের ৩ জন বাড়িতেই ছিলেন। তাই তাঁরা বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষা পান।
পিয়ানোবাদক মেরিলিন পল দুর্ঘটনার দিন সময়ের থেকে ৩০ মিনিট আগে গির্জায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু ওই দিন দুপুরে তাঁর বাড়িতে ভালমন্দ রান্না হয়েছিল। রাতে ভূরিভোজের কারণে পল ঘুম থেকে উঠেছিলেন দেরি করে।
পলের মা নিজে ছিলেন ওই দলের সর্বেসর্বা। তিনিই বকলমে ওই দল চালাতেন। তাঁরও ওই দিন ছেলের সঙ্গে তাড়াতাড়ি গির্জায় যাওয়ার কথা ছিল।
পলকে ঘুম থেকে ওঠাতে তাঁর মায়ের দম বেরিয়ে গিয়েছিল। মায়ের ডাকে ওই দিন পল ঘুম থেকে উঠেছিলেন ৭টা ১৫ মিনিটে। ফলে পল এবং তাঁর মা, কারোরই সময়ে গির্জায় পৌঁছানো হয়নি। পল যখন গির্জায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তাঁরা শুনতে পান গির্জায় বিস্ফোরের শব্দ।
ওই গির্জায় কোরাস গাইতে যেতেন হাই স্কুলের দুই ছাত্রী লুসিল জোন্স এবং ডরোথি উড। তবে তাঁরা গির্জায় সব সময় একজোটে যেতেন।
কিন্তু সেই সন্ধ্যায়, একটি রেডিয়ো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কারণে লুসিলের দেরি হয়ে গিয়েছিল। লুসিল রেডিয়ো স্টেশন থেকে বেরিয়েছিলেন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ। তখন ইতিমধ্যেই বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছিল।
লুসিলের জন্য অপেক্ষা করায় ডরোথিও ওই দিন সময়ে গির্জায় পৌঁছতে পারেননি। ফলে দু’জনেই বিস্ফোরণের হাত থেকে বেঁচে যান।
দুই বোন, রোয়েনা এবং স্যাডি এস্টেস দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যাবেলা গির্জায় যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়েছিলেন। কিন্তু বেরিয়ে দেখেন, তাঁদের বাড়ির গাড়ি খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। তখন দুই বোন গাড়িতে লিফট্ দেওয়ার জন্য ডেকে পাঠান তাঁদের বন্ধু লাডোনা ভ্যান্ডারগ্রিফ্টকে।
লাডোনা নিজেও প্রতিদিন ঠিক সময়ে গির্জায় পৌঁছে যেতেন। কিন্তু ঠিক ওই দিনই স্কুলের দেওয়া কিছু গণিতের হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে দেরি হয়ে যায় লাডোনার। ফলে লাডোনা এহং এস্টেস বোনেরা বিস্ফোরণের বেশ কিছু ক্ষণ পরে গির্জায় পৌঁছন।
হার্বার্ট কিফ নামে লেদ কারখানার এক কর্মীও ছিলেন ওই কোরাস দলের সদস্য। তিনি গির্জায় সময়ে পৌঁছনোর জন্য অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠির কথা ভেবে আবার অফিসে ফিরে যান। যখন গির্জায় বিস্ফোরণ ঘটে তখনও হার্বার্ট তাঁর অফিসেই ছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দা শুস্টার এবং তাঁর ছোট্ট মেয়ে সুসানও প্রতি দিন গির্জায় কোরাস গাইতে যেতেন। কিন্তু ওই দিন তাঁদের একবার শুস্টার বাপের বাড়িতে ঢুঁ মেরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানেই তাঁদের দেরি হয়ে যায়। প্রাণে বাঁচেন শুস্টার এবং সুসান।
কারিগর হার্ভে আলের বেঁচে যাওয়ার পিছনে কৃতিত্ব ছিল তাঁর স্ত্রীর। দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে বাইরে থেকে ফিরে আসতে দেরি করে ফেলেন হার্ভের স্ত্রী। ফলে তাঁদের চার জনেরই গির্জায় যেতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল।
স্টেনোগ্রাফার জয়েস ব্ল্যাক বেঁচে যান আলস্যের কারণে। তিনি গির্জার সব থেকে কাছে থাকতেন। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যায় খুব ঠান্ডা থাকায় তিনি অনেক ক্ষণ লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। বিস্ফোরণের আওয়াজে তাঁর টনক নড়ে। বুঝতে পারেন যে, বরাত জোরে রক্ষা পেয়েছেন তিনি।
ওই দিন সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে ওয়েস্ট সাইড ব্যাপটিস্ট গির্জায় বিস্ফোরণ ঘটেছিল। দমকলকর্মীরা জানিয়েছিলেন, গ্যাস লিক করার কারণে ওই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। কিন্তু এক যোগে ১৫ জন বেঁচে যাওয়ায় ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই হইহই পড়ে যায়। লোকমুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, স্বয়ং ভগবানই নাকি তাঁদের বাঁচিয়েছিলেন।