২০২২ সাল। প্রকাশিত হয় হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট। ধস নামে শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা আদানি গ্রুপের শেয়ারদরে। অনেকে বলতে শুরু করেন, আদানির সাম্রাজ্যের ইতি ঘটল। রাতারাতি এই গোষ্ঠীর বাজারদর প্রায় ৬৫% পড়ে যায়। অর্থাৎ যে সংস্থার বাজারদর ছিল ১৯ লক্ষ কোটি টাকা, তা প্রায় ৭ লক্ষ কোটি টাকা হারিয়ে সাড়ে ১২ লক্ষ কোটি টাকায় এসে পৌঁছয়।
এক বছর পর পরিস্থিতি কিন্তু অনেকটাই সামলে নিয়েছেন আদানি। আবার ফিরেছেন স্বমহিমায়। কী এমন হল এক বছরে? টাকা নয়ছয়ের যে অভিযোগ ছিল সংস্থার বিরুদ্ধে, ফের শীর্ষে ওঠার সিড়িতে তেমন কোনও কালি লেগে নেই তো? রয়েছে হাজারো প্রশ্ন।
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্ট। তারা জানায়, হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট যা বলে, সব সময় তা সত্যি হয় না। কেন্দ্রীয় সংস্থার উপর ভরসা রাখতে হবে। শুরু হয় সেবির তদন্ত। ২৪টি অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত করছে তারা। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব তদন্ত শেষ হওয়ার কথা।
বিষয়টিতে কেন হস্তক্ষেপ করল সুপ্রিম কোর্ট? অভিযোগ ওঠে, হিন্ডেনবার্গ ‘মিথ্যা’ খবর ছড়িয়ে কোনও সংস্থার শেয়ারের দামের পতন ঘটাতে পারে। আর এই ভাবেই নাকি হিন্ডেনবার্গ মুনাফা কামায়।
সুপ্রিম কোর্টের উদ্বেগ ছিল, রিপোর্টের প্রভাবে লোকসান শুধু সংস্থার নয়, শেয়ারহোল্ডারদেরও হয়। আদানি যে পরিমাণে টাকা খুইয়েছে, তার মধ্যে সাধারণ মানুষেরও টাকা রয়েছে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদেরও লোকসান হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্টও। তারা জানিয়েছিল, এই রিপোর্ট তদন্তে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এর ভিত্তিতে হতে পারে না। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ-সহ কয়েক জন আদানির বিরুদ্ধে বিশেষ তদন্ত চেয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট বলে, তদন্ত সেবি করবে।
এর পর এক বছরে আদানিদের সংস্থাগুলির শেয়ারদর অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। কিন্তু হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশের আগে যত মূল্য ছিল, সেই পর্যায়ে এখনও পৌঁছয়নি।
রিপোর্টে যে অভিযোগ ছিল, তা আদানি মানেননি। হিন্ডেনবার্গের যখন রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন নতুন একটি এফপিও আসে আদানির। ২০ হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তুলতে চাইছিল তারা। রিপোর্টের জন্য ধাক্কা খায় এফপিও।
তবু শেষ দিন অনেকটাই এফপিওর মাধ্যমে টাকা তুলেছিল আদানির সংস্থা। কিন্তু আদানি সেই টাকা পরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গ্রাহকদের। এ ভাবে দুনিয়ার সামনে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা তুলে ধরতে চেয়েছিল আদানি। তা পেরেও ছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।
এত টানাপড়েনের মাঝে আদানির ক্রেডিট রেটিং কম করেনি কোনও ক্রেডিট সংস্থা। এর ফলে স্বল্পমেয়াদি লোকসানের প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে পড়েনি।
খারাপ সময়েও কোনও শীর্ষকর্তা আদানির সংস্থা ছাড়েননি। পাশাপাশি, সংস্থায় বিনিয়োগও ক্রমাগত আসতে থাকে। এই সময়েও জিকিউজি পার্টনারস, ফ্রান্স, কাতারের সংস্থা ৭৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে।
আবু ধাবির সংস্থাও বিনিয়োগ করে। ওই সংস্থার সঙ্গে রাজপরিবারের যোগ রয়েছে। তারা আদানি এন্টারপ্রাইজের ৫ শতাংশ শেয়ার কেনে।
এসবিআই আদানি সংস্থার পিভিসি প্রকল্পে ৩৪ হাজার কোটি বিনিয়োগ করে। এর ফলে আদানি সংস্থার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। আস্থা বাড়তে থাকে বিনিয়োগকারিদেরও।
দেশে এখন ছ’টি বিমানবন্দর পরিচলানা করছেন আদানিরা। তালিকায় রয়েছে আমদাবাদ, লখনউ, জয়পুর, মেঙ্গালুরু, তিরুঅনন্তপুরম, গুয়াহাটি বিমানবন্দর। নবি মুম্বই বিমানবন্দরও খুলতে চলছে এ বছরই। সেটিও আদানিদের।
মুম্বইয়ের ধারাভি বস্তি সংস্কারের চুক্তিও পেয়েছে আদানি সংস্থা। ২০২২ সালে দরপত্র হাঁকা হয়। গত এক বছরে কড়াইকাল বন্দর, কোস্টাল এনার্জি অধিগ্রহণ করেছেন আদানি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সাত লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছেন আদানি। আরও একটি বিষয় হল, আদানি গোষ্ঠীর সব ‘অ্যাসেট ফিজ়িক্যাল’। চাইলে ব্যাঙ্ক সব বিক্রি করে টাকা নিতে পারবে।
বিগত দিনে আদানির সংস্থার ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কর্তা সংস্থার অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেন। আদানি আত্মবিশ্বাসী, তিনি ঋণ মেটাতে পারবেন। এতে আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরাও।
শ্রীলঙ্কায় ৭০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে আদানির সংস্থা। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫,৮০০ কোটি টাকা। চিনের প্রভাব কমাতে গুরুত্বপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসা শুরু করেছে তারা। বন্দর করছে। এ সব কারণেই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম আদানির সংস্থা। যদিও ক্ষতিপূরণ পুরোপুরি হয়নি।