চম্বলের নাম শুনলেই দস্যু, ডাকাতি, খুন, এই বিষয়গুলিই মাথায় আসে। আরও একটি নাম এই চম্বলের সঙ্গে জড়িত ছিল। তিনি হলেন দস্যু ফুলন দেবী। তার পরই চম্বলের মহিলা ডাকাত হিসাবে নাম উঠে আসে সীমা পরিহারের। এক সাধারণ গরিব পরিবারের মেয়ে কী ভাবে চম্বলের ত্রাস হয়ে উঠলেন?
মা বাবার সঙ্গে ভাঙাচোরা ঘরে শুয়েছিল চার বোন এবং দুই ভাই। মধ্যরাত। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি চলছিল। হঠাৎই বাইরে গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেন তাঁরা। তার পরই দরজায় সজোরে লাথি। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে গেল দরজা। তিন জন পুরুষ এবং এক জন মহিলা-সহ ১০ জন ঘরে ঢুকে পড়লেন। তার পর গালিগালাজ করতে করতে ছয় ভাইবোনের মধ্যে বড় মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যায় তাঁরা।
বছর তেরোর মেয়েটিকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েক জন অজ্ঞাতপরিচয় লোক। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য বাবা-মা, ভাই-বোনের পরিত্রাহী চিৎকার সেই রাতের বৃষ্টির আওয়াজকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই দলটি বৃষ্টির মধ্যেই চম্বলের বীহড়ের দিকে চলে যায়। ১৩ বছরের সেই মেয়েটি আর কেউ নন, পরবর্তী কালে চম্বলের ত্রাস হয়ে ওঠা সীমা পরিহার। উত্তরপ্রদেশের ববাইন গ্রামে বাবা-মা ভাই-বোনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডাকাতদলের সর্দার হয়ে উঠেছিলেন ছোট্ট এই মেয়েটি।
সাল ১৯৮৩। দস্যুদের হাতে অপহৃত হওয়ার পর সীমা তাঁদের কাছে মিনতি করেছিলেন ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ছেড়ে দেওয়া তো দূর অস্ত্, মেয়েটিকে সারা রাত ধরে হাঁটিয়ে বীহড় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৌঁছে সীমা বুঝতে পারেন তাঁকে যাঁরা অপহরণ করেছেন, তাঁরা চম্বলের কুখ্যাত ডাকাত লালারাম এবং তার সঙ্গী শ্রীরাম, সুরেশ লোধী এবং সুষমা নাইন।
সীমাকে বন্দি বানিয়ে লাগাতার ধর্ষণ করেন লালারামের দলের সদস্যরা। সীমা ভেবেছিলেন, বাড়ির লোকেরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তা হয়নি। পুলিশ তাঁর অভিযোগও নেয়নি বলে দাবি করেন সীমার বাবা।
কেউ তাঁকে উদ্ধার করতে আসছেন না দেখে, সীমা বীহড়ের জঙ্গল থেকে বেশ কয়েক বার পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু লালারাম তাঁর সঙ্গীদের কড়া নির্দেশ দিয়েছিল যে, পালানোর চেষ্টা করলেই যেন সীমাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
ইতিমধ্যেই তিন বছর কেটে গিয়েছিল। তত দিনে লালারামের দলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন সীমা। এক দিন কাছাকাছি একটি গ্রামে মেলা বসেছিল। সেই মেলায় সীমার সঙ্গে দেখা হয় তাঁরই গ্রামের একটি ছেলের। তিনি সীমাকে জানান, তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সীমার মা-বাবাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ।
লালারামকে সীমা প্রশ্ন করেছিলেন, “আমি তো কিছুই করিনি। বন্দুকও ধরিনি। কিন্তু আমার মা-বাবার সঙ্গে এ রকম করা হল কেন?” পুলিশের অত্যাচারের কথা শুনে হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন সীমা। তখন তার বয়স মাত্র ১৬। আর এখান থেকেই সীমা হয়ে উঠে চম্বলের কুখ্যাত ডাকাত।
একের পর এক অপহরণ করে মোটা টাকা মুক্তিপণ দাবি করতে থাকেন সীমা। টাকাও আসছিল। কিন্তু অস্ত্রের টান পড়ছিল। শুরু হল অস্ত্র লুট করার কাজ। দল নিয়ে একের পর এক থানায় হামলা চালিয়ে বন্দুক, গুলি লুট করা শুরু করে সীমার দল। ক্রমেই পুলিশের কাছে ত্রাস হয়ে ওঠেন সীমা। দিনের বেলাতেও থানায় হামলা চালিয়ে লুটপাট করত তারা। পুলিশকর্মীদের খুন করে সেখান থেকে চম্পট দিত। ক্রমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সীমা সম্পর্কে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়। ২০০টি অপহরণ, ৭০টি খুন এবং ৩০টি খুনের মামলায় পুলিশের খাতায় নাম ওঠে তাঁর।
ববাইন গ্রামে সেঙ্গর ঠাকুরদের প্রভাব ছিল। এক মাত্র সীমার বাবাই ছিলেন পরিহার ঠাকুর সম্প্রদায়ের। সেঙ্গার ঠাকুররা সীমার বাবাকে সব সময় হেনস্থা করতেন। অভিযোগ, সীমার বাবাকে পঞ্চায়েত প্রধান গম্ভীর সিংহ বলেছিলেন, “তোমার চার মেয়েকে আমাদের গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে বিয়ে দাও, তোমাকে আমরা জমি, ঘর দেব।” কিন্তু সীমার বাবা তা মানতে চাননি। অভিযোগ, এর পরই গম্ভীর সিংহ ডাকাতদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সীমাকে অপহরণ করান।
ডাকাতদলে মিশে যাওয়ার পর সীমার প্রথম লক্ষ্য ছিলেন গম্ভীর সিংহ। ববাইন গ্রামেই ঠাকুরদের ঘরে লুটপাট, খুন করা শুরু করেন সীমা। সীমার ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দেন ঠাকুররা। ধীরে ধীরে সীমা পুরো চম্বলের ত্রাস হয়ে ওঠেন। কুখ্যাত ডাকাতরাও সীমার কথায় ওঠাবসা শুরু করেন। তাঁর নির্দেশ মেনে চলতে শুরু করেন। কপালে কালো টিকা, মাথায় লাল ফেট্টি এবং জলপাইরঙা উর্দিই হয়ে উঠেছিল সীমার হিংস্রতার প্রতীক।
গোটা চম্বল এবং তার আশপাশ যখন সীমার ভয়ে কাঁটা, সেই সময়ে ওই দলে নতুন সদস্যের আবির্ভাব হয়। তাঁর নাম নির্ভয় গুর্জর। নির্ভয়ের প্রেমে পড়েন সীমা। লালারাম দু’জনের বিয়ে দেন। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। এর মধ্যেই সীমা এক দিন বীহড় লাগোয়া একটি গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে যেতেই মহিলারা তাঁকে জানান, লালারামের দলের বেশি কিছু লোক গ্রামে এসেছিল। তাদের মধ্যে এক জনের নাম নির্ভয় ছিল। তিনি গ্রামেরই এক তরুণীকে ধর্ষণ করেন।
এর পরই নির্ভয়কে দল থেকে তাড়িয়ে দেন সীমা। দু’বছর বাদে ১৯৯৭-৯৮ সালে দলের পান্ডা লালারামকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে লালারাম-সীমার এক সন্তান হয়। সন্তানের ১০ মাস বয়সে লালারাম পুলিশের গুলিতে মারা যান। সীমা একা পড়ে যান। পুলিশ তাঁকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য সীমা ১০ মাসের সন্তানকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকছিলেন। পুলিশের ভয়ে পালাতে পালাতে ক্লান্ত সীমা স্থির করেন, এ বার আত্মসমর্পণ করা উচিত। সীমার দাদাকে বিষয়টি জানান সীমা। তিনি পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। বাড়ি, জমি, চাকরি-সহ বেশ কয়েকটি শর্তে ১৮ বছর পর আত্মসমর্পণ করে সীমা।
তিন বছর তিন মাস জেলে ছিলেন সীমা। তাঁর বিরুদ্ধে ২৯ মামলা চলে। যার মধ্যে আটটি খুন এবং একাধিক অপহরণের মামলা ছিল। পুলিশও তাঁকে দেওয়া শর্ত পূরণ করেনি বলে দাবি করেন সীমা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে চিঠিও লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু কোনও জবাব আসেনি বলেও দাবি সীমার। এক সাক্ষাৎকারে সীমা জানান, জেলে থাকাকালীনই তাঁর কাছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব আসে। ২০০২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শিবসেনাকে সমর্থন করেন তিনি। ২০০৬-এ ইন্ডিয়ান জাস্টিস পার্টিতে যোগ দেন। এর পর ২০০৮ সালে সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন।
সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর পরই ১৫টি অপরাধের মামলা থেকে রেহাই পান সীমা। জামিন পান ১৪টি মামলায়। ২০১১ সালে রাজ্যের দুর্নীতি পরিষদের মহিলা সেলের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সীমার চরিত্রের আধারে ‘উন্ডেড’ নামে একটি ছবি তৈরি করা হয়। মুখ্য চরিত্রে ছিলেন সীমা নিজেই। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার তিন বছর পর ২০১০ সালে রিয়ালিটি শো ‘বিগ বস সিজন-৪’-এ প্রতিযোগী হিসাবে অংশ নেন সীমা। চম্বলের এক কুখ্যাত ডাকাত থেকে ‘বিগ বস’-এর সেটে হাজির হওয়ার বেশ নজর কেড়েছিলেন সীমা।