প্রকাশ্য দিবালোকে লন্ডনের এক বাজারে তিন আততায়ীর হাতে নিহত হন জন ফোর্ড নামের এক পাদ্রি। আততায়ীদের এক জন একটি ১১ ইঞ্চি লম্বা ছুরি দিয়ে তাঁর গলা কাটেন। অন্য দু’জন তাঁর পেট ফালা ফালা করে দেন। ঘটনা চতুর্দশ শতকের।
ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছিল ফোর্ডের। সমকালীন তদন্তে জানা যায়, এলা ফিৎজ়পাইন নামের এক ধনী ও প্রভাবশালী মহিলা তিন ভাড়াটে খুনিকে নিয়োগ করেছিলেন ফোর্ডকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু একটি বিষয় কিছুতেই বোঝা যায়নি, ঠিক কেন এলা এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন।
২০১৮ সলে কেম্ব্রিজ ইনস্টিটিউট অফ ক্রিমিনোলজির ডেপুটি ডিরেক্টর ম্যানুয়েল এইজ়নার এক বিশেষ কাজে হাত দেন। তিনি মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের খতিয়ান নিয়ে একটি ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। এই মানচিত্রে হত্যার স্থানগুলিকে চিহ্নিত করা ছিল। সেই চিহ্নিত জায়গাগুলিতে ক্লিক করলেই জানা যাবে কী ভাবে, কাকে, কারা, কী কারণে হত্যা করেছিলেন।
এই মানচিত্র তৈরি করতে তাঁর স্ত্রী এবং স্টেফানি ব্রাউন নামে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইতিহাসবিদের সাহায্য নিয়েছিলেন এইজ়নার। বিভিন্ন হত্যারহস্যের ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে এইজ়নার ফোর্ডের ঘটনায় এসে থমকান। ফোর্ডকে কারা হত্যা করেছিলেন জানা গেলেও এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী কারণ কাজ করেছিল, তা জানতে তিনি উৎসুক হয়ে পড়েন।
এইজ়নার এবং তাঁর গবেষক দল বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ১৩৩২ সালের ২৯ জানুয়ারি তৎকালীন আর্চবিশপ অফ ক্যান্টারবেরি সাইমন মেথ্যামের লেখা একটি চিঠির সন্ধান পান। চিঠিটি আর্চবিশপ লিখেছিলেন উইনচেস্টারের বিশপের উদ্দেশে। এই চিঠিতেই এলা ফিৎজ়পাইনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আর্চবিশপের চিঠি থেকে জানা যায় যে, গর্হিত অপরাধের কারণে এলাকে গুরুতর শাস্তি দেওয়া হয়। তাঁকে সাত বছর ধরে প্রতি দিন খালি পায়ে হেঁটে স্যালিসবেরি ক্যাথিড্রালে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে যেতে হত। সেই সঙ্গে এই সাত বছর তিনি কোনও গয়না পরতে পারবেন না এবং কোনও রকম প্রসাধন করতে পারবেন না বলেও বিধান দেওয়া হয়।
কোন অপরাধে এলাকে এ হেন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল? উত্তর খুঁজতে গিয়ে এইজ়নার ও তাঁর গবেষক দল জানতে পারেন, এলা সমসাময়িক লন্ডনে এক রকম মক্ষীরানি হিসেবে জীবনযাপন করতেন। অসংখ্য নাইট, অভিজাত, প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং এমনকি গির্জার ক্ষমতাশালী সন্ন্যাসীদের সঙ্গেও তাঁর শরীরী সম্পর্ক ছিল। এই ব্যাভিচারের কারণেই তাঁর শাস্তিবিধান করা হয়।
এর পরে যে প্রশ্নটি এইজ়নারদের ভাবায়, তা হল এই যে, এলা কেন ফোর্ডকে হত্যা করার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করবেন? আবার শুরু হয় অনুসন্ধান। বিস্তর নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, এলার গোপন প্রেমিকদের তালিকায় সন্ন্যাসী ফোর্ডও ছিলেন। এলার শাস্তিবিধানের সময় অবশ্য তাঁর কী ভূমিকা ছিল, তা জানা যায়নি। তবে অনুমান করা যায় যে, এলাকে গির্জার রোষ থেকে বাঁচাতে ফোর্ড কোনও উদ্যোগ নেননি। এবং তিনি নিজেও এই বিতর্কিত বিষয় থেকে দূরে থাকেন। অপমানিতা এলা প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতেই ফোর্ডকে লোক লাগিয়ে হত্যা করান।
৭০০ বছর আগেকার এই হত্যারহস্য যে এ ভাবে উদ্ঘাটিত হবে, তা বহু অপরাধ বিশেষজ্ঞই কল্পনা করতে পারেননি। আসলে এই রহস্যের কিনারা হওয়ার মূলে রয়েছে এইজ়নার ও তাঁর সহকারীদের তৈরি ‘হত্যা-মানচিত্র’।
সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এই ‘ইন্টার্যাক্টিভ’ মানচিত্রকে নির্মাণ করা হয়েছে। লন্ডন, ইয়র্ক এবং অক্সফোর্ড— এই তিনটি শহরে মধ্যযুগের ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলিকেই এই মানচিত্রে স্থান দেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডগুলি যে সব স্থানে ঘটেছিল, সেই জায়গাগুলিকে হত্যার অস্ত্র বা হত্যাপদ্ধতির প্রতীক দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই চিহ্নগুলিতে মাউস নিয়ে গিয়ে ক্লিক করলেই সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের বিশদ পাওয়া যাবে।
মধ্যযুগে ঘটে যাওয়া অপরাধকে আজ চিহ্নিত করা ও সেগুলির বিশদ সংগ্রহ করা খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু সেই দুরূহ কাজটিই সম্ভব করে দেখিয়েছেন এইজ়নার ও তাঁর দল। কাজটি করতে সেকালের তিনটি শহরের বিশদ মানচিত্র, শহরবাসীদের জীবনযাপনের ধাঁচ, নাগরিক ক্ষমতা কাঠামো, বাসিন্দাদের অপরাধ প্রবণতা, বিচারপ্রক্রিয়া ও শাস্তির ধরন ইত্যাদি বহু কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে হয়েছিল তাঁদের।
এই মানচিত্র তৈরির মাধ্যমে এইজ়নার আধুনিক অপরাধ ও বিচারব্যবস্থার এক কুলুজি নির্মাণ করতে চেয়েছেন। মধ্যযুগীয় এই হত্যা-মানচিত্র থেকে এ কথাও উঠে আসে যে, আধুনিক কালে হত্যাপরাধের চরিত্রে কতখানি বদল এসেছে।
এইজ়নার এই মানচিত্রকে এক ‘দূরবর্তী দর্পণ’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, এই মানচিত্রকে হিংসা ও রিরংসার কুলুজি ভাবলে ভুল হবে। এটি একটি সময়যানের সমতুল।
এইজ়নার মধ্যযুগীয় অপরাধের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ২০১২ সাল নাগাদ। প্রথমে খেলাচ্ছলেই তিনি ও তাঁর স্ত্রী ব্যপারটা শুরু করেন। এইজ়নারের স্ত্রী রান্নাঘর থেকেই চতুর্দশ শতকের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিবরণ পড়ে শোনাতেন। অন্য দিকে, লন্ডন শহরের একটি বড়স়ড় মানচিত্র নিয়ে তাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলির জায়গায় পিন বসিয়ে দিতে থাকেন এইজ়নার।
হত্যাকাণ্ডগুলির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত জানার জন্য এইজ়নার সমকালীন ইংল্যান্ডের ‘করোনারস রোল’ এবং আইনি নথিপত্র ব্যবহার করেছেন। ‘করোনার’রা ছিলেন সেই সময়ের এক ধরনের বিশেষজ্ঞ বিচারক, যাঁরা অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্ত করে তার ব্যাখ্যা করতেন। কোনও হত্যাকাণ্ড ঘটলে করোনাররা সংশ্লিষ্ট এলাকার ১২ থেকে ৫০ জন বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিষয়টির তত্ত্বতালাশ করতেন এবং সেই সব তথ্য নথিবদ্ধ করতেন। এই নথিগুলিই ‘করোনারস রোল’ নামে পরিচিত। এই নথিগুলিতে মৃতের পরিচয়, হত্যার সময়, হত্যাস্থল, কী ভাবে হত্যা করা হয়েছে, হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের চরিত্র ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ লেখা থাকত।
সব ক্ষেত্রেই যে করোনারস রোলগুলি সম্পূর্ণ হত, এমন নয়। বহু ক্ষেত্রেই খুনিকে চিহ্নিত করা যেত না। কোথাও কোথাও আবার খুনের কারণ অজ্ঞাত থেকে যেত। ফোর্ডের হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও করোনারস রোল অসম্পূর্ণ ছিল।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসহবিদ স্টেফানি ব্রাউন প্রাচীন নথিপত্রের পাঠোদ্ধারের কাজে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। তাঁর সহায়তাতেই মধ্যযুগীয় করোনারস রোলের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়। সেই সব নথির অধিকাংশই ছিল প্রাচীন লাতিনে লেখা।
সে কালের অনেক জায়গারই আজ আর অস্তিত্ব নেই বা তাদের নাম বদলে গিয়েছে। এইজ়নারের দল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই কাজটি করে উঠতে পেরেছে। আজকের লন্ডন, ইয়র্ক এবং অক্সফোর্ডের মানচিত্রের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই মধ্যযুগের স্থানগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে মানচিত্রে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাস-ভিত্তিক রহস্য কাহিনি বিশ্ব জুড়েই জনপ্রিয়। এই মানচিত্র শুধু ইতিহাসের গবেষক বা ছাত্রদের কাজে আসবে না। রহস্য কাহিনির লেখকদেরও কাজে আসতে পারে মধ্যযুগের হত্যা-মানচিত্র। লেখা হতে পারে আরও নিখুঁত রহস্য আখ্যান, এমন আশা রহস্যপ্রেমীদের।