হেলফায়ার আর৯এক্স বা ‘নরকের আগুন’। এই মূহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে চর্চিত ক্ষেপণাস্ত্র মনে হয় এটিই। কারণ এই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই আল কায়দা প্রধান আয়মান আল জওয়াহিরিকে হত্যা করল আমেরিকা।
জওয়াহিরির মৃত্যুর পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বক্তৃতা করার সময় বলেন, আল কায়দা প্রধানকে খতম করলেও এই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে কোনও সাধারণ মানুষ আহত বা নিহত হননি। আবার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের সময় ছোট বা বড় কোনও বিস্ফোরণের আওয়াজও হয়নি। পাওয়া যায়নি বিস্ফোরণের চিহ্নও।
বাইডেন সরকারের এক কর্তা সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে জানিয়েছেন, জওয়াহিরিকে হত্যা করার সময় তিনি কাবুলের একটি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। ৩১ জুলাই সূর্যোদয়ের এক ঘণ্টা পরেই তাঁকে নিধন করে দু’টি হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র।
কী ভাবে কাজ করে এই মারণ ক্ষেপণাস্ত্র? কেনই বা সন্ত্রাস দমনে আমেরিকার অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে এটি?
হেলফায়ার আর৯এক্স ‘নিনজা বোমা’ নামেও পরিচিত। সাধারণ মানুষের কোনও ক্ষতি না করে লক্ষ্যকে আঘাত করার উদ্দেশ্যেই এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে আমেরিকা।
হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্রটি মানবহীন ড্রোন থেকে ছোড়া হয়। কোনও বিস্ফোরক থাকে না এই ক্ষেপণাস্ত্রে। বদলে থাকে ছ’টি ধারালো ব্লেড।
ক্ষেপণাস্ত্রের ভিতরে থাকা ধারালো ব্লেডগুলি লক্ষ্যবস্তুর কাছে গিয়ে উচ্চ গতিতে বেরিয়ে আসে। এর পর ফালাফালা করে কেটে ফেলে লক্ষ্যবস্তুকে। শত্রু নিধনের পর আবার ফিরে যায় ক্ষেপণাস্ত্রের ভিতরে। ঠিক যেন পুরাণে বর্ণিত বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র।
এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই এটিকে ‘ফ্লাইং জিনসু’ বলা হয়। ১৯৮০-এর দশকে জাপানের বাজারে এক বিশেষ ধরনের ধারালো ছুরি আসে যা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রও মসৃণ ভাবে কাটতে সক্ষম ছিল। সেই ছুরির নামই ‘জিনসু’।
এই ক্ষেপণাস্ত্রের প্রভাব কী রকম হতে পারে তা সিরিয়ার ইদলিবে হেলফায়ারের আঘাতে ধ্বংস হওয়া একটি গাড়ির ছবি দেখলেই বোঝা যায়। এই ছবি সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে।
পেন্টাগন এবং সিআইএ, এই দুই সংস্থায় প্রধানত জঙ্গিনেতাদের দমনের জন্য যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়। জওয়াহিরির ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। যদিও দুই সংস্থার পক্ষ থেকেই হেলফায়ার আর৯এক্স ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার কথা স্বীকার করা হয়নি।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল (ডব্লিউএসজে)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেন এবং অন্যান্য দেশে আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে সাধারণ জনগণের মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তার পর থেকেই আমেরিকার তরফে এমন এক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির উপর জোর দেওয়া হয়, যার আঘাতে লক্ষ্যবস্তু ছাড়া আর কারও কোনও ক্ষতি না হয়।
হেলফায়ার আর৯এক্স ক্ষেপণাস্ত্র সমস্ত সামরিক অভিযানে ব্যবহার করা হয় না। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার নিয়ম রয়েছে। মূলত লুকিয়ে বা গোপন ঘাঁটিতে থাকা জঙ্গি নেতাকে নিশ্চুপে খতম করতেই এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
ডব্লিউএসজে প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে যে, ২০১১ সালের প্রথম দিকে এই বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাজ শুরু হয়।
আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পর প্রকাশ করা রিপোর্টে ডব্লিউএসজে জানিয়েছে, এর আগে লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন এবং সোমালিয়ার সামরিক অভিযানে হেলফায়ার ব্যবহার করা হয়েছে।
হেলফায়ার আর৯এক্স ক্ষেপণাস্ত্রটি পাঁচ ফুটের চেয়ে একটু বেশি লম্বা এবং ওজন ৪৫ কেজির কিছু বেশি।
পাশাপাশি হেলফায়ার আর৯এক্স একটি ‘স্টেলথ’ ক্ষেপণাস্ত্র। অর্থাৎ শত্রুপক্ষের র্যাডারে ধরা না পড়েই এই ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছে যেতে সক্ষম।
ওসামা বিন লাদেনের পর ৯/১১ হামলার অন্যতম চক্রী ছিলেন জওয়াহিরি। ৯/১১ হামলার পর থেকেই তাঁকে বাগে আনার চেষ্টা করছিল আমেরিকা। সেই চেষ্টাই সাফল্য পেল। পূর্ণ হল বৃত্ত।