পাকিস্তানের শ্রমিক এবং কর্মীদের কাজ দিতে চাইছে না পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি! পাকিস্তানি নাগরিকদের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলা নিয়েও সতর্কতা জারি করেছে কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ।
এমনকি, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি ইসলামাবাদকে চিঠি পাঠিয়ে নাগরিকদের ‘সহবত’ শেখানোর উপদেশও দিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে সৌদি আরব চায় না যে পাকিস্তান সরকার তাদের দেশে কর্মী পাঠাক।
পাক সংবাদমাধ্যম জিওটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাসী পাকিস্তানিদের বিষয়ে সেনেটের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সম্প্রতি এই উদ্বেগের বিষয়টি উঠে আসে।
প্রবাসী পাকিস্তানিদের সচিব আরশাদ মাহমুদ কমিটিকে জানিয়েছেন যে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব, কাতার এবং কুয়েত চায় না যে পাকিস্তানি কর্মীরা তাদের দেশে গিয়ে কাজ করুন।
কিন্তু কেন এমন পশ্চিম এশীয় ‘বঞ্চনা’র মুখে পড়েছে পাকিস্তান? রিপোর্ট বলছে এর জন্য পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে কাজ করতে যাওয়া পাক কর্মীরাই দায়ী। তাঁদের কাজকর্মে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছে সৌদি আরবের মতো দেশ।
কর্মসংস্থানের জন্য পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে গিয়ে কী এমন কাণ্ড ঘটান পাক কর্মীরা, যে তাঁদের সহবত শেখানোর কথা বলা হচ্ছে?
আরশাদ কমিটিকে জানিয়েছেন, প্রতি বছর প্রায় ৬ লক্ষ থেকে ৮ লক্ষ পাকিস্তানি দেশ ছেড়ে বিদেশে যান। কিন্তু ফিরে আসেন দুই থেকে তিন লক্ষ মানুষ।
সংযুক্ত আরব আমিরশাহির নিয়ম অনুযায়ী, বার্ষিক ১৬ লক্ষ পাকিস্তানি সে দেশে থাকতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা ১৮ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে।
রিপোর্ট এ-ও বলছে যে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে হওয়া অপরাধের প্রায় ৫০ শতাংশের নেপথ্যে রয়েছেন সে দেশে থাকা পাকিস্তানিরা।
উদ্বেগ রয়েছে আরও। রিপোর্ট এ-ও বলছে যে, পাকিস্তানিরা তীর্থযাত্রার নামে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে যাচ্ছেন এবং সেখানে গিয়ে ভিক্ষা করা শুরু করছেন। ভিক্ষার টাকা জমিয়ে কেউ ফিরে আসছেন, তো কেউ সেখানেই রয়ে যাচ্ছেন পাকাপাকি ভাবে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আরশাদ একই কমিটিকে জানিয়েছিলেন, দেশ ছেড়ে যাওয়া সমস্ত পাকিস্তানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন ভিক্ষুকেরাই। এর পর বিদেশে গিয়ে ভিক্ষা করা দু’হাজার নাগরিকের পাসপোর্ট স্থগিত করে তাঁদের সাত বছরের জন্য ব্ল্যাকলিস্ট করেছিল পাকিস্তানের সরকার। সরকার জানিয়েছিল, ওই পাকিস্তানিরা বিদেশে গিয়ে ভিক্ষা করে নিজেদের দেশের নাম ডোবাচ্ছেন।
সম্প্রতি বেশ কয়েক জন পাকিস্তানি পুরুষ দুবাইয়ে গিয়ে মহিলাদের আপত্তিকর ভিডিয়ো তুলতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। কাতারে আবার পাক শ্রমিকেরা হেলমেট পরে কাজ করতে অস্বীকার করেছেন। সব মিলিয়ে পাকিস্তানি শ্রমিক এবং কর্মীদের নিয়ে জেরবার হচ্ছে আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারের প্রশাসন।
সৌদি আরব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র সেই কর্মীদের কাজ করার সুযোগ দেবে, যাঁরা ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট’ দ্বারা পরিচালিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন।
২০১৫ সালের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন)-র রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার পরিযায়ী শ্রমিকদের ৯০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থানের জন্য পশ্চিম এশিয়ায় কোনও দেশে চাকরি নেন।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের অনিশ্চিত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বেকারত্বের কারণে পাকিস্তানের সাড়ে সাত লক্ষেরও বেশি শিক্ষিত তরুণ কর্মসংস্থানের জন্য পাকিস্তান ছেড়়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। ২০২০ এবং ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২ লক্ষ ৮৮ হাজার এবং ২ লক্ষ ২৫ হাজার।
এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদন বলছে, পাকিস্তান থেকে ২০২২ সালে বিদেশে যাওয়া তরুণ-তরুণীর মধ্যে প্রায় ৯২ হাজার এমন মানুষও ছিলেন, যাঁরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইটি বিশেষজ্ঞ এবং হিসাবরক্ষকের মতো পেশার সঙ্গে যুক্ত।
তবে এ বার আর পাকিস্তানিদের কাজে নিতে চাইছে না পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে পাকিস্তানের মুখ যেমন পুড়েছে তেমনই বিপদ বেড়েছে সে দেশের।
পাকিস্তানি শ্রমিকেরা পশ্চিম এশিয়ায় কাজ করতে গেলে তাঁদের মারফত বহু টাকা সে দেশে ঢোকে। ফলে সমৃদ্ধ হয় অর্থনীতি। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানে বিদেশের টাকা ঢোকার পরিমাণ বাড়েনি। তবে এ বার যদি পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি পাক নাগরিকদের আর কাজে রাখতে না চায়, তা হলে এই টাকার পরিমাণ আরও কমবে।
প্রতি বছর কর্মসংস্থানের জন্য পাকিস্তানি শ্রমিকেরা সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির পাশাপাশি ওমান, কুয়েত, বাহরাইন এবং কাতারের মতো খনিজ তেল সমৃদ্ধ দেশগুলিতে পাড়ি দেয়। যার ফলে পাকিস্তানের স্থানীয় চাকরির বাজারের চাপ খানিক কমে।
তবে এখন যদি সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং সৌদি আরবের মতো দেশগুলি পাক শ্রমিকদের থেকে মুখ ফেরায়, তা হলে পাকিস্তানের চাকরির বাজারে প্রভাব পড়বে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।