আমেরিকার শেয়ার সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’-এর রিপোর্টের দাবি, এক দশক ধরে শেয়ারের দরে কারচুপি করছে আদানি গোষ্ঠী। সংস্থার ২৪ জানুয়ারির রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বিপর্যয়ের মুখে আদানি গোষ্ঠী। কিন্তু আদানি গোষ্ঠী যে এই পরিস্থিতির মুখে পড়তে চলেছে, সেই ‘অশনি সঙ্কেত’ অনেক আগেই দিয়েছিল অন্য এক সংস্থার রিপোর্ট।
গত বছরের অগস্ট মাস নাগাদ ব্যবসায় পাল্লা দিয়ে মুকেশ অম্বানীকে টপকে দেশের সব থেকে ধনী ব্যক্তি হিসাবে জায়গা পান গৌতম আদানি। শুধু দেশেরই না, বেশ কয়েকটি রিপোর্ট অনুযায়ী আদানি তখন এশিয়ারও ধনীতম ব্যক্তি। কিন্তু তখনই ‘ক্রেডিট সাইট’-এর এক সমীক্ষায় উঠে আসে চমকে দেওয়া তথ্য।
‘ক্রেডিট সাইট’-এর ওই সমীক্ষার দাবি ছিল, আদানি গোষ্ঠীর সাফল্যের চাকচিক্যের পিছনে রয়েছে পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা। আদানির ঋণের পরিমাণ সেই সময়ই প্রায় ২.২২ লক্ষ কোটি টাকা হয়ে গিয়েছিল বলেও ওই সমীক্ষায় দাবি করা হয়।
ওই সমীক্ষায় জানানো হয়, গত বছর বিশ্ব বাজারে আদানির ঋণের পরিমাণ ছিল ১.৫২ লক্ষ কোটি টাকা। এক বছরে এই ঋণের পরিমাণ তো কমেইনি, উল্টে ৪২ শতাংশ বেড়ে ২.২২ লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে। এই ঋণের ভার মারাত্মক হতে পারে বলেও সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছিল।
বিদেশি আর্থিক লগ্নি সংক্রান্ত পরামর্শদাতা সংস্থা ‘ক্রেডিট সাইট’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসার বাড়বাড়ন্তের পিছনে রয়েছে ব্যাপক আর্থিক দেনা। এই দেনার কারণে আদানি গোষ্ঠীকে বিপদে পড়তে হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয় সমীক্ষায়।
বিভিন্ন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে পা বাড়িয়ে আদানি গোষ্ঠী পৌঁছে গিয়েছে তাপবিদ্যুৎ এবং গ্রিন এনার্জিতেও। আদানির এই রমরমা দেশ-বিদেশের খ্যাতনামী ব্যবসায়ী সংস্থারও নজর কেড়েছে।
কিন্তু ‘ক্রেডিট সাইট’-এর ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, ব্যবসা বৃদ্ধি করতে আদানি গোষ্ঠী যে ঋণ নিয়েছে, তাতে বড় বিপদে পড়তে পারে সংস্থা।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছিল, আদানির বিদেশি মুদ্রায় নেওয়া ঋণের পরিমাণও অনেক। সেই সময় এই খবরও ছড়িয়ে পড়ে যে, বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) কাছ থেকে নতুন করে প্রায় ১৪ হাজার কোটির ঋণ নেওয়ার আবেদন করেছেন আদানি। এই নতুন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে গ্রিন এনার্জি সংক্রান্ত ব্যবসাও। এর ফলে ঋণের বোঝা আরও বাড়তে পারে বলেও দাবি করা হয়েছিল।
তার মধ্যেই পলিভিনাইল ক্লোরাইড প্ল্যান্ট তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছিল আদানি গোষ্ঠী। কয়লা থেকে পলিভিনাইল ক্লোরাইড উৎপাদন করার লক্ষ্যেই গুজরাতের মুন্দ্রায় কারখানা তৈরির সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল।
অন্য একটি সমীক্ষাতেও দাবি করা হয়েছিল, আদানি গোষ্ঠীর অন্তর্গত সমস্ত সংস্থাগুলির মধ্যে আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেডই সব থেকে বেশি ঋণগ্রস্ত। শুধু তাই নয়, এশিয়ার মধ্যেও সব থেকে ঋণগ্রস্ত সংস্থার তালিকায় এই সংস্থার স্থান দ্বিতীয়। প্রথমে রয়েছে চিনের একটি সংস্থা।
কিন্তু কেন এত ঋণ নিয়েছে আদানি গোষ্ঠী? অনেকে এর জন্য আদানি গোষ্ঠীর সব ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের কারণকেই দায়ী করা হয় সমীক্ষায়।
গুজব রটে, দীর্ঘ দিন ধরেই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছেন গৌতম। আর সেই সংক্রান্ত একাধিক বিনিয়োগের ফলেই এই ঋণের অঙ্ক বেড়েছে।
এর মধ্যেই দেশের টেলিকম সেক্টর এবং মিডিয়াতেও পা রাখেন আদানি। তা নিয়ে যথেষ্ট শোরগোলও পড়ে। ৫জি নিলামেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
একই সঙ্গে প্রশ্নও উঠেছিল, কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার নামে এত টাকার ঋণ থাকা দেশের অর্থনীতির উপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?
আদানিদের প্রচুর ঋণ থাকার গুজব থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্র আদানি গোষ্ঠীর বিনিয়োগের প্রতি আস্থা রেখেছে। আদানি গোষ্ঠী নতুন ভারতের রূপ গড়তেও বিশেষ ভূমিকা রাখবে, এই আস্থার কথা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদীও।
কিন্তু ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’-এর রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই আদানিদের ১০টি সংস্থার শেয়ারে ধস নামে। আদানিরা বিবৃতিতে অভিযোগ করে, হিন্ডেনবার্গ স্বল্পমেয়াদি মুনাফার জন্য রিপোর্ট তৈরি করেছে। এই রিপোর্ট ভারতের অগ্রগতিকে রোখার চক্রান্ত বলেও দাবি করে আদানি গোষ্ঠী। এই আক্রমণাত্মক বিবৃতি সত্ত্বেও অবশ্য হাল ফেরেনি। উপরন্তু, হিন্ডেনবার্গ পাল্টা বলে, জাতীয়তাবাদের আড়ালে প্রতারণা ঢাকা দেওয়া যায় না।
চলতি অর্থবর্ষের বাজেট পেশের পর আদানিদের বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার উল্লেখযোগ্য হারে নেমেছে। কোনও শেয়ারে ১৭ শতাংশ পতন হয়েছে, তো কোনও শেয়ার এক ধাক্কায় ৫১ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
এর আগেও ব্যাপক ঋণের ভারে নুয়ে পড়ে বা কারচুপি করার কারণে এর আগেও বিভিন্ন সংস্থাকে দেউলিয়া হতে দেখা গিয়েছে। ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে নীরব মোদী এবং বিজয় মালিয়ার মতো ব্যবসায়ীকেও দেশ ছাড়তে দেখেছে সাধারণ মানুষ।