চলতি বছরের বাজেটে সোনার উপর আমদানি শুল্ক হ্রাস করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। তার পর কিছু দিনের জন্য খুচরো বাজারে কমেছিল হলুদ ধাতুর দর। উৎসবের মরসুমের মুখে ফের বাড়ছে দাম। যা দেখে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছিল সোনার দর। ওই দিন হলুদ ধাতুর স্পট মূল্য আউন্স প্রতি ২,৬৩৮.৩৭ ডলারে পৌঁছয়। অন্য দিকে আমেরিকায় সোনার ফিউচার চলে যায় ২,৬৬১.৬০ ডলারে।
বর্তমানে ঘরোয়া বাজারে ২৪ ক্যারেট সোনার প্রতি ১০ গ্রামের দাম ৭৬ হাজার টাকা ছাপিয়ে গিয়েছে। আর ২২ ক্যারেট হলুদ ধাতুর দর ৭২ থেকে ৭৩ হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। গয়না তৈরিতে মূলত ব্যবহার করা হয় এই ২২ ক্যারেট সোনা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগামী দিনে ভারতের বাজারে আরও বাড়বে সোনার দাম। হলুদ ধাতুর প্রতি ১০ গ্রামের দর ৭৮ হাজার টাকা পর্যন্ত যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে জিএসটি দিয়ে সোনার দর ৮০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এই দাম বৃদ্ধির পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে।
সোনার দাম চড়ার প্রধান কারণ হিসাবে আমেরিকার ফেডারেল ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্তকে দায়ী করা হচ্ছে। সম্প্রতি সুদের হার কমিয়েছে আটলান্টিকের পারের দেশটির কেন্দ্রীয় আর্থিক সংস্থা। পাশাপাশি, বিশ্ববাজারে দর কমেছে ডলারের।
বর্তমানে ভারত, রাশিয়া, চিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি ডলারকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। যা আর্থিক দিক থেকে আমেরিকাকে চাপে ফেলেছে। সোনাকে দীর্ঘ দিন ধরেই নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম বলে মনে করা হয়। কিন্তু আমেরিকায় সুদের হার কমে যাওয়ায় এবং ডলারের দর হ্রাস পাওয়ায় অনেকেই লগ্নি সোনায় সরাচ্ছেন। এর সরাসরি প্রভাব বাজারে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অস্থিরতা সোনার দর বৃদ্ধির দ্বিতীয় বড় কারণ। ২০২২ সাল থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলছে যুদ্ধ। গত বছর (২০২৩ সাল) থেকে পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েলের সঙ্গে হামাস ও হিজ়বুল্লার শুরু হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। যাতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরাও।
পশ্চিম এশিয়ার এই যুদ্ধে অন্তত চারটি দেশে সরাসরি জড়িয়ে রয়েছে। সেগুলি হল ইজ়রায়েল, লেবানন, ইয়েমেন ও ইরান। হিজ়বুল্লার মূল ঘাঁটি রয়েছে ইহুদি দেশটির উত্তরের লেবাননে। আর হামাস, হিজ়বুল্লা ও হুথিদের মদত যুগিয়ে যাচ্ছে ইরান।
পশ্চিম এশিয়ার এই সংঘাতে সিরিয়া, মিশর ও সৌদি আরব জড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হবে তা বলাই বাহুল্য। তখন সোনার দর আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, যুদ্ধ বাড়লে আমজনতার পাশাপাশি সরকারি স্তরে হলুদ ধাতু কেনা ও তা মজুত করার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
তৃতীয়ত, ভারতে উৎসবের মরসুমে সোনার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে দীপাবলি ও ধনতেরাসে অনেকেই সোনার গয়না কেনেন। চাহিদা বৃদ্ধির কারণে হলুদ ধাতুর দর বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গয়না ব্যবসায়ীদের একাংশের অনুমান, দীর্ঘ মেয়াদে সোনার দাম বিশ্ব বাজারে আউন্স প্রতি তিন হাজার ডলারে পৌঁছবে। তবে দর হু হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিক্রি যে অনেকটাই কমেছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন তাঁরা। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা।
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য এখনই সোনায় বিনিয়োগের শ্রেষ্ঠ সময় বলে উল্লেখ করেছেন। তাতে লগ্নিকারীরা এর দাম বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা। বাজারের দিকে নজর রেখে এই বিনিয়োগ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালানো যেতে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরো বিক্রি যে অনেকটাই ধাক্কা খাচ্ছে তা স্পষ্ট করেছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। তাঁদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া জেম অ্যান্ড জুয়েলারি ডোমেস্টিক কাউন্সিল’-র অধিকর্তা সমর দে জানিয়েছেন, ‘‘পুজোর বাজার অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বার একেবারেই ভাল নয়। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ গয়না কিনছেন না। দাম আরও বেড়ে গেলে ব্যবসা মার খাবে।’’
ব্যবসায়ীদের দাবি, কেন্দ্রীয় বাজেটে শুল্ক কমার পর সোনার দর ৬৮ হাজার টাকায় নেমে এসেছিল। তখন বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। বিক্রি ঠিক রাখতে দাম ৭০ হাজারের মধ্যে থাকুক, চাইছেন তাঁরা।
অখিল ভারতীয় স্বর্ণশিল্পী সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক টগর পোদ্দার জানিয়েছেন, ‘‘পুজোর বাজার কমে যাওয়ায় চিন্তা হচ্ছে। আমরা ধনতেরাস নিয়ে উদ্বেগে রয়েছি। ওই সময় প্রত্যাশা মতো সোনা বিক্রি না হলে সমস্যা হবে।’’
‘গোল্ড অক্টোবর ফিউচার্সের’ নিরিখে সর্বকালীন উচ্চতায় উঠেছে সোনার দাম। ২৫ সেপ্টেম্বর মাল্টি কমডিটি এক্সচেঞ্জে (এমসিএক্স) ৭৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে ১০ গ্রাম হলুদ ধাতু। গত এক সপ্তাহে এখানে প্রতি ১০ গ্রামে ২ হাজার ৯০০ টাকা বেড়েছে সোনার দাম।