অশান্ত বিশ্ব। তিন বছর পেরিয়ে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনও থামেনি। ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইল সংঘাতে রক্তাক্ত পশ্চিম এশিয়া। এই আবহে নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে দুনিয়ার অধিকাংশ দেশ। পিছিয়ে নেই ভারতও। গত বছরের তুলনায় এ বার ফৌজের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
প্রতিরক্ষা খাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বরাদ্দ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ়’ (আইআইএসএস)। ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতর। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয় সর্বকালীন উচ্চতায় পৌঁছয়। এর অঙ্ক ছিল ২.৪৬ লক্ষ কোটি ডলার। ফৌজি বাজেটের এ হেন বৃদ্ধিকে ক্রমবর্ধমান সামরিক উচ্চকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসাবে ব্যাখ্যা করেছে এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
আইআইএসএস জানিয়েছে, প্রতিরক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রয়েছে ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকার। গত বছর এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ছিল ৯৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০২৩ সালের তুলনায় ফৌজি খরচ বৃদ্ধি করেছে মার্কিন সরকার। সে বার সামরিক খাতে ওয়াশিংটন ৯১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছিল।
প্রতিরক্ষা খাতে খরচের নিরিখে আমেরিকার পড়েই রয়েছে চিনের স্থান। গত বছর ড্রাগন সরকার প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ করে ২৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। বর্তমানে বেজিঙের হাতে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী। ফৌজি শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে টক্কর দিতে ক্রমাগত সামরিক খরচ বাড়িয়ে চলেছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) শুরু করার পর থেকে ধীরে ধীরে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি করেছে রাশিয়া। গত বছর এতে ১৪ হাজার ৫৯০ কোটি ডলার ব্যয় বরাদ্দ করে মস্কো। বর্তমানে এর সিংহভাগ অর্থ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সাইবার নিরাপত্তা এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে খরচ করছে ক্রেমলিন।
‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’-এর তালিকা অনুযায়ী, ফৌজি শক্তিতে বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে আমেরিকা। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানটি ধরে রেখেছে যথাক্রমে রাশিয়া এবং চিন। মজার বিষয় হল, গত বছর এই দুই দেশের মিলিত বাজেটের চেয়ে ৫৮ হাজার ৭১০ কোটি ডলার অতিরিক্ত খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।
সামরিক শক্তিতে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’-এর তালিকায় প্রথম ১০-এ জায়গা না পেলেও জার্মানির প্রতিরক্ষা বাজেট ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। গত বছর ফৌজি খাতে বার্লিনের ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। সেনার জন্য খরচের দিক দিয়ে বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে মধ্য ইউরোপের এই দেশ। তবে মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চিনের মতো জার্মানি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র নয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে পশ্চিম ইউরোপের আমেরিকার শক্তি জোট নেটোভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে। এই মহাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ইঙ্গিতও দিয়েছেন ট্রাম্প। এতে রাশিয়ার আরও বেশি আগ্রাসী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তাই বর্তমানে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বৃদ্ধির কথা খোলাখুলি ভাবেই বলছেন জার্মান রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’-এর তালিকায় ছ’নম্বর স্থান পেয়েছে ব্রিটেন। এক কালের দুনিয়া জো়ড়া সাম্রাজ্য তৈরি করা আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্রটির গত বছরের ফৌজি বাজেট ছিল ৮ হাজার ১১০ কোটি ডলার। অর্থাৎ সে দিক থেকে এখনও দুনিয়ার পঞ্চম স্থানে রয়েছে পরমাণু শক্তিধর রাজা তৃতীয় চার্লসের দেশ।
সৈন্য শক্তিতে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে থাকলেও প্রতিরক্ষা বাজেটের নিরিখে ছ’নম্বরে রয়েছে ভারত। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে পেশ করা বাজেটে ২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরের জন্য প্রতিরক্ষা খাতে ৬.৮১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে এই অঙ্ক ছিল ৬ লক্ষ ২১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বারের সেনা বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ।
এ বারের প্রতিরক্ষা বাজেটের মোট বরাদ্দের মধ্যে মূলধনী ব্যয়ের পরিমাণ ১ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা ধার্য করেছে মোদী সরকার। অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম কেনা এবং সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার আধুনিকীকরণের জন্য এই অর্থ ব্যয় করবে মন্ত্রক। মূলধনী ব্যয়ের মধ্যে, বিমান এবং অ্যারো ইঞ্জিনের জন্য ৪৮ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
এ ছা়ড়া যুদ্ধজাহাজের জন্য ২৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা খরচ করবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। বেতন ও পেনশন সংক্রান্ত ব্যয়ে ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং রাজস্ব ব্যয়ে ৪ লক্ষ ৮৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও ২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরে খরচ করবে ২৬ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি গবেষণা এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতিতে ১৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্র।
ভারতীয় ফৌজের আধুনিকীকরণের জন্য ১ লক্ষ ১১ হাজার ৫৪৪.৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে মোদী সরকার। ঘরোয়া সংস্থাগুলির থেকে অস্ত্র কেনার জন্য মোট বরাদ্দ হওয়া টাকার ২৫ শতাংশ ব্যবহার করা হবে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সীতারামন। দেশীয় প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি আগামী আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৫-’২৬) ২৭,৮৮৬.২১ কোটি টাকার বরাত পাবে বলে এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটের পর পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
বর্তমানে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়ে ৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। এই অঙ্ক ১০ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার দাবি তুলেছেন সাবেক সেনাকর্তারা। তাঁরা মনে করেন, প্রতিরক্ষা খাতে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) অন্তত আড়াই শতাংশ সরকারের খরচ করা উচিত। এ বছর জিডিপির ১.৯ শতাংশ বরাদ্দ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।
আইআইএসএসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফৌজের জন্য খরচের নিরিখে সপ্তম, অষ্টম এবং নবম স্থানে রয়েছে সৌদি আরব, ফ্রান্স এবং জাপান। গত বছর এই তিন দেশের প্রতিরক্ষা ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ১৭০ কোটি, ৬ হাজার ৪০০ কোটি এবং ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। জার্মানির রাস্তায় হেঁটে ফ্রান্স এবং জাপান প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধির রাস্তা ধরতে পারে, ইঙ্গিত মিলেছে ইতিমধ্যেই।
গত কয়েক বছর ধরেই ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে চিনা ‘দাদাগিরি’। এই পরিস্থিতিতে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা সম্পূর্ণ ভাবে নিজেদের কাঁধে রাখতে নারাজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর তাই প্রতিরক্ষা বাজেট দ্রুত বৃদ্ধি করার রাস্তায় হেঁটেছে টোকিয়ো। একই অবস্থা দক্ষিণ কোরিয়ারও। গত বছর এই খাতে ৪ হাজার ৩৯০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছিল সোল।
গত বছর অস্ট্রেলিয়া এবং ইটালির প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল যথাক্রমে ৩ হাজার ৬৪০ কোটি এবং ৩ হাজার ৫২০ কোটি ডলার। অন্য দিকে ২০২৩ সাল থেকে ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হামাস, হিজবুল্লা, হুথি এবং তেহরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালেও ফৌজি খরচ তেমন বৃদ্ধি করেনি ইজ়রায়েল। ২০২৪ সালে সেনার জন্য ৩ হাজার ৩৭০ কোটি ডলার খরচ করেছে বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন গত বছর প্রতিরক্ষা খাতে ২ হাজার ৮৪০ কোটি ডলার খরচ করেছে বলে জানা গিয়েছে। সম পরিমাণ প্রতিরক্ষা বাজেট পোল্যান্ডেও। তবে এ বছর থেকে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালু করার পরিকল্পনা করেছে ওয়ারশ’ সরকার। এতে পূর্ব ইউরোপের দেশটির ফৌজি বাজেট বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।