ষাটের দশকের শেষ দিকে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে একের পর এক তরুণীকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল। তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, ওই তরুণীদের খুনের আগে তাঁদের মুখে আঘাত করতে বেদম লাথি-ঘুষি মারা হয়েছিল। এর পর তাঁদের ধর্ষণ করে খুনি।
আঠারো মাসের মধ্যে গ্লাসগোয় ৩ জন তরুণী খুনের ঘটনায় শহর জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। গোয়েন্দাদের দাবি, সব ক’টি খুন করেছেন সিরিয়াল কিলার ‘বাইবেল জন’। স্কটল্যান্ডের অপরাধ জগতে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যিনি অধরা।
খুনির নাম ‘বাইবেল জন’ কেন? গোয়েন্দাদের দাবি, প্রতিটি শিকারের কাছেই বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর পঙ্ক্তি আওড়েছিলেন অভিযুক্ত। তাঁদের নীতিবোধেরও শিক্ষা দিতেন তিনি। সে কারণেই ওই নামে পরিচিত হয়ে যান খুনি। যদিও এই যুক্তির পক্ষে প্রমাণ দিতে পারেননি গোয়েন্দারা।
‘বাইবেল জনের’ নামে আরও অনেক জনশ্রুতি হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। তিনি নাকি কখনও মদ ছুঁয়ে দেখেননি। নেশা করার বদলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করাটাই নাকি তাঁর পছন্দের। বাবার মতোই তিনিও নাকি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, যে সমস্ত বিবাহিতারা নাচের আসরে যান, তাঁরা আসলে ‘নষ্ট’ চরিত্রের। এমনকি, বিবাহিতাদের নাচ করাটাই নাকি অন্যায়!
‘বাইবেল জন: ক্রিয়েশন অফ আ সিরিয়াল কিলার’ নামে বিবিসি-র একটি পডকাস্টে দাবি করা হয়েছে, গ্লাসগোর বাসিন্দা জন আর্ভিন ম্যাকিইন্স আসলে ওই সিরিয়াল কিলার। ১৯৮০ সালে যিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। এ নিয়ে গোয়েন্দাদের কাছে বহু তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।
প্রমাণ থাকলেও খুনিকে কেন পাকড়াও করেনি পুলিশ? বিবিসি-র ওই পডকাস্টে দাবি করা হয়েছে, নিজের পরিচয় গোপন রাখতে ‘বাইবেল জন’-কে সাহায্য করেছিলেন পুলিশের শীর্ষকর্তারাই। কারণ, ওই সিরিয়াল কিলার নাকি আসলে এক শীর্ষকর্তার তুতো ভাই।
ব্রিটিশ পডকাস্টটি যে দাবিই করুক না কেন, ম্যাকিইন্সই যে ‘বাইবেল জন’ তা নিয়ে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছিল স্কটল্যান্ডের গোয়েন্দারা। বস্তুত, ১৯৬৮ থেকে ’৬৯ সালের মধ্যে আঠারো মাসে গ্লাসগোয় যে ৩ তরুণীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল, তাঁদের খুনি কে বা কারা, তা আজও অজানা।
গোয়েন্দাদের দাবি, ষাটের দশকের শেষে প্যাট্রিসিয়া ডকার (২৫), জেমাইমা ম্যাকডোনাল্ড (৩২) এবং হেলেন পাটক (২৯)-এর খুনি একই ব্যক্তি। প্রত্যেকেরই খুনির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল গ্লাসগোয় ‘বরোল্যান্ড বলরুম’ নামে একটি প্রেক্ষাগৃহে। এর পর তাঁদের প্রায় একই ভাবে খুন করা হয়।
সম্প্রতি স্প্যানিশ লেখিকা ডলোরেস রেডান্ডো তাঁর উপন্যাসে দাবি করেছেন, ‘বাইবেল জন’ জীবিত। গ্লাসগো পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভুয়ো পরিচয়ে তিনি স্পেনের উত্তরাঞ্চলের বন্দরশহর বিলবাওয়ে লুকিয়ে রয়েছেন। সেখানকার সমাজে প্রতিষ্ঠিত তিনি।
‘বাইবেল জনের’ প্রথম শিকার ছিলেন প্যাট্রিসিয়া ডকার নামে এক নার্স। ১৯৬৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্লাসগোর ব্যাটলফিল্ড এলাকায় কারমাইকেল প্লেসে একটি গ্যারাজের সামনে থেকে তাঁর নগ্ন দেহ উদ্ধার হয়েছিল। লংসাইড প্লেসে তাঁর বাড়ির কয়েক গজ দূরেই ছিল ঘটনাস্থল।
গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন, খুনের আগে প্যাট্রিসিয়ার মুখে এবং মাথায় লাথি-ঘুষি ছাড়াও ভোঁতা কিছু দিয়ে মারধর করা হয়েছিল। এর পর তাঁকে ধর্ষণ করা হয় বলেও অভিযোগ। ধর্ষণের পর হয়তো বেল্টজাতীয় কিছু দিয়ে শ্বাসরোধ করে প্যাট্রিসিয়াকে খুন করা হয়েছিল। ঘটনাস্থলে তাঁর পরনের জামাকাপড়, ঘড়ি এবং হাতব্যাগ পাওয়া যায়নি। পরে তল্লাশি অভিযানে একটি জলাশয় থেকে হাতব্যাগটি উদ্ধার হয়েছিল।
স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কহীন এক শিশুসন্তানের মা প্যাট্রিসিয়ার খুনি কে ছিলেন? কেনই বা তাঁকে খুন করা হয়েছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন গোয়েন্দারা। যদিও তদন্তে জানা গিয়েছিল, ঘটনার রাতে ‘বরোল্যান্ড বলরুম’-এ নাচতে গিয়েছিলেন প্যাট্রিসিয়া। ময়নাতদন্তে যৌন নির্যাতনের স্পষ্ট না পাওয়া গেলেও গোয়েন্দাদের দাবি, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল।
প্যাট্রিসিয়া খুন হওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যে গ্লাসগোর জেমাইমা ম্যাকডোনাল্ডের দেহ পাওয়া যায়। ১৬ অগস্ট ওই দেহটিও নগ্ন অবস্থায় উদ্ধার হয়। ৩ সন্তানের মা স্বামীহীন জেমাইমাও খুনের রাতে ‘বরোল্যান্ড বলরুম’-এ নাচতে গিয়েছিলেন। মধ্যরাতে তিনি বাড়ি ফেরেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সে সময় জেমাইমার সঙ্গে ছিলেন প্রায় ৬ ফুট লম্বা ২৫-৩৫ বছরের এক রোগাপাতলা যুবক। ছোট করে ছাঁটা বাদামি চুলের ওই যুবকটির পরনে কেতাদুরস্ত পোশাক ছিল। তাঁর কথাবার্তা এবং আচরণও নাকি মার্জিত। ওই রাতে ‘বরোল্যান্ড বলরুম’-এ কথাবার্তার সময়ও যুবকটি নাকি বাইবেলের বুলি আওড়াচ্ছিলেন।
পরের দিন জেমাইমার বাড়ির সামনে তাঁর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। তাঁর জুতো এবং স্টকিংস পাশেই পড়েছিল। যদিও প্যাট্রিসিয়ার মতো তাঁর পরনের জামাকাপড় গায়েব ছিল না। ময়নাতদন্তে জানা গিয়েছিল, জেমাইমাকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছিল। খুনের আগে জেমাইমার মুখে লাথিঘুষি চলেছিল। এর পর স্টকিংস দিয়ে শ্বাসরোধ করে তাঁকে খুন করা হয়েছিল।
খুনের রাতে জেমাইমার সঙ্গে যে যুবককে দেখা গিয়েছিল, তাঁর বর্ণনা পেলেও পুলিশের কাছে অধরাই থেকে যান তিনি। তবে তদন্তকারীরা এ বার দু’টি খুনের মধ্যে মিল খুঁজে পেতে শুরু করেছেন। খুনের সময় প্যাট্রিসিয়া এবং জেমাইমা, দু’জনেই কমবয়সি, কালো বা বাদামি চুলের তরুণী এবং তাঁদের ঋতুচক্র চলছিল। দু’জনকেই খুনের আগে মুখে লাথি-ঘুষি মারা হয়েছিল। তাঁরা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। এবং ঘটনাস্থল থেকে তাঁদের হাতব্যাগ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া, তাঁরা স্বামীবিচ্ছিন্না ছিলেন।
বিস্তর তল্লাশি চালিয়েও খুনের কারণ কী অথবা খুনি কে, তা ধরতে পারছিলেন না তদন্তকারীরা। এরই মধ্যে তৃতীয় খুন হয় গ্লাসগোয়। ৩১ অক্টোবর ১৯৬৯ সালে আর্ল স্ট্রিটের ফ্ল্যাটের কাছে একটি নর্দমার পাশে হেলেন পাটকের অর্ধনগ্ন দেহ পড়েছিল।
তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, খুনের আগে হেলেনকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এবং তাঁর মুখেও মারধরের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। হেলেনের স্টকিংস দিয়ে শ্বাসরোধ করে তাঁকে খুন করা হয়েছিল বলেও জানিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। তাঁর হাতব্যাগটিও ঘটনাস্থলে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর উরুতে কামড়ানোর দাগ পাওয়া গিয়েছিল। খুনির সঙ্গে তাঁর যে হাতাহাতি হয়েছিল, সে প্রমাণ মিলেছিল। প্যাট্রিসিয়া এবং জেমাইমার মতো খুনের সময় তাঁরও ঋতুচক্র চলছিল।
খুনের আগের দিনও গ্লাসগোর ওই বলরুমে গিয়েছিলেন হেলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বোন জাঁ লংফোর্ড। সেখানে তাঁদের সঙ্গে জন নামের দু’জন যুবকের আলাপ হয়েছিল। হেলেনের বোন পুলিশকে জানিয়েছিলেন, ওই যুবকদের মধ্যে এক জন অত্যন্ত বাক্পটু। যদিও তিনি কোথায় থাকেন, তা জানাননি। ট্যাক্সিতে করে তাঁকে বাড়িও পৌঁছে দেন ওই যুবক এবং তাঁর বোন।
তদন্তকারীদের দাবি, মিনিট কুড়ির ওই ট্যাক্সি-সফরের যে বিবরণ দিয়েছিলেন হেলেনের বোন, তা থেকে খুনির মনোজগতের হদিস পাওয়া গিয়েছিল। সেই রাতে লংফোর্ডকে তাঁর বাড়িতে নামিয়ে হেলেনের সঙ্গে ট্যাক্সিতে চলে যান ওই যুবক।
হেলেনের বোনের দাবি, মৃদুভাষী ওই যুবক মদ বা সিগারেটের নেশা করতেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি মদ্যপান করি না। (ঈশ্বরের কাছে) প্রার্থনা করি।’’ তবে মদের নেশা না থাকলেও গ্লাসগোর বিভিন্ন পানশালা তাঁর নখদর্পণে ছিল। এ ছাড়া, বিবাহিতাদের যে নাচ করা উচিত নয়, বাবার শেখানো এই কথায় বিশ্বাস করেন ওই যুবক। এবং যে বিবাহিতারা নাচের ফ্লোরে যান, তাঁরা ব্যভিচারী হন।
নানা জনের বয়ান সত্ত্বেও খুনিকে পাকড়াও করতে পারেনি পুলিশ। বস্তুত, ওই তরুণীদের খুনের পর ৭,০০০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন তদন্তকারীরা। পাশাপাশি ৪,০০০ জনের বয়ান রেকর্ড করা হয়েছিল। তবে অভিযুক্তকে গ্রেফতারি তো দূরের কথা, ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর হদিস পায়নি গ্লাসগো পুলিশ।