ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি সরকারের সমালোচনা করে সম্প্রতি শিরোনামে উঠে এসেছেন আমেরিকার শিল্পপতি জর্জ সোরস। বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাশালী ধনকুবের তিনি।
আমেরিকার লগ্নি সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ তুলে যে রিপোর্টটি প্রকাশ্যে এনেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই মুখ খুলেছেন সোরস। নরেন্দ্র মোদী এবং তার সরকারের নীতিগুলিকে কটাক্ষ করেছেন।
সোরস হাঙ্গেরি বংশোদ্ভূত আমেরিকান শিল্পপতি। ১৯৩০ সালের ১২ অগস্ট তাঁর জন্ম হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে এক ইহুদি পরিবারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি বিরোধীর নীতির মুখে জাল পরিচয়পত্র ব্যবহার করে প্রাণ বাঁচিয়েছিল সোরসের পরিবার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাঙ্গেরি থেকে সপরিবারে লন্ডনে চলে আসেন সোরস। সেখানেই তাঁর পড়াশোনা, উচ্চশিক্ষা। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে পড়াশোনা শেষ করে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন সোরস। পরে চলে আসেন আমেরিকায়।
ষাট এবং সত্তরের দশকে সোরসের কেরিয়ারের গ্রাফ ছিল ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ‘ডবল ঈগল’, ‘সোরস ফান্ড ম্যানেজমেন্ট’ নামের একের পর এক তহবিল চালু করেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যে আমেরিকার ইতিহাসে সফলতম ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার হয়ে ওঠেন সোরস।
ব্রিটেনে অর্থনীতির অন্যতম কালো অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সোরস। ১৯৯২ সালে ব্রিটেনের অর্থনীতি ভেঙে ফেলার অন্যতম মূল চক্রী হিসাবে উঠে আসে তাঁর নাম।
সোরস এক হাজার কোটি ডলার অর্থমূল্যের পাউন্ড কিনে অল্প সময়ের মধ্যে তা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে প্রচার করেছিলেন, পাউন্ডের উপর তাঁর ভরসা নেই। এই প্রক্রিয়ায় তিনি প্রায় ১০০ কোটি ডলার লাভ করেছিলেন। সোরসের এই কৌশলে ব্রিটেনে প্রবল অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়।
ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংস্থা চালু করেন সোরস। এই সংস্থা বিশ্ব জুড়ে ১০০টিরও বেশি দেশে সমাজসেবামূলক কাজ করে থাকে। সে সব দেশের তালিকায় রয়েছে ভারতও।
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের আওতায় যে সমাজের মানুষ মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেন, যেখানে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার সুরক্ষিত, একমাত্র সেই সমাজেই উন্নয়ন, বিকাশ সম্ভব। এমনটাই মনে করেন সোরস। তাই বিশ্বের নানা প্রান্তে ‘আক্ষরিক অর্থে প্রকৃত গণতন্ত্রের’ পক্ষে সোচ্চার হয়ে থাকেন।
সোরসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ব্যক্তিগত সম্পদের ভান্ডার থেকে ৩২০০ কোটি ডলারের বেশি (ভারতীয় মুদ্রায় ২ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা) অর্থ ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে জনসেবামূলক কাজে বিলিয়ে দিয়েছেন। ২০২০ সালে ফোর্বসের তরফে তাঁকে ‘সবচেয়ে উদার দাতা’-র তকমা দেওয়া হয়।
‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন বা ব্যক্তিগত পরিসরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক সমানাধিকার, সাম্য এবং গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে সাহায্য করেন সোরস। সমলিঙ্গ বিবাহ থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষদের স্কলারশিপ— সব ক্ষেত্রেই সোরসের অবদান রয়েছে।
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশের পর ভারত সরকারের সমালোচনা করে সোরস বলেন, ‘‘এই বিষয়ে নরেন্দ্র মোদী নীরব। কিন্তু বিদেশি লগ্নিকারীদের কাছে ওঁকে জবাব দিতে হবে। আদানিদের এই বিপর্যয় ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে মোদীর দমননীতিকেও দুর্বল করে দেবে।’’
ভারত প্রসঙ্গে সোরস আরও বলেন, ‘‘ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। আদানিদের বিপর্যয় মোদী সরকারের দমন শিথিল করলে সেই সংস্কারের পথ তরাণ্বিত হবে। আমি হয়তো অনেক কিছুই জানি না, কিন্তু আমি চাই ভারতে একটি গণতান্ত্রিক উত্থান ঘটুক।’’
ভারত সরকারের তরফে সোরসের মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি বলেছেন, ‘‘ভারতের গণতন্ত্রকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলছে। ভারতের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে বহির্বিশ্বে। তা ঠেকিয়ে রেখেছেন একমাত্র নরেন্দ্র মোদী।’’
এই প্রথম নয়, আগেও মোদী সরকারের সমালোচনা শোনা গিয়েছিল সোরসের মুখে। ২০২০ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। মুসলমান নাগরিকদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতি ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক।’’
বর্তমানে সোরসের বয়স ৯২ বছর। কিন্তু বয়সের ভারে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রাঙ্গণে তাঁর দাপট নুইয়ে পড়েনি এতটুকু। তাঁর কৌশলকে আজও সমীহ করে চলেন বিশ্বের তাবড় ধনকুবের। তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তাঁর মন্তব্যেও শোরগোল শুরু হয়েছে।