বিতর্ক দিয়েই শুরু হয়েছিল এ বছর গঙ্গাসাগর মেলা। করোনা স্ফীতির আবহে মেলা হওয়া উচিত কি না— এটাই ছিল একমাত্র প্রশ্ন। তবে তার উত্তর খুঁজতে জেরবার হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে রাজ্য ও দেশের রাজনীতি, আইন-আদালত, এমনকি চিকিৎসা-স্বাস্থ্যবিভাগ-সমাজকর্মীরাও।
মেলা বন্ধের আর্জি নিয়ে প্রথম থেকেই সরব হয়েছিলেন সমাজকর্মীদের একাংশ। আবার অন্য অংশের বক্তব্য ছিল করোনা আবহে সবই যখন হয়েছে, বর্ষবরণ, বড়দিনের উৎসব বাদ যায়নি তখন পুণ্যার্থীরা কী দোষ করল? অনেকে এমন প্রশ্নও তুলেছিলেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন যখন কুম্ভমেলা বন্ধ করা হয়নি তখন গঙ্গাসাগরের জনসমাগমে কোপ কেন?
এই নিয়ে নেট মাধ্যমে সমালোচনা, ব্যঙ্গচিত্রের জোয়ার। আদালতে একের পর এক মামলা দায়ের হয়। অন্যদিকে, ভক্তদের অধিকার খর্ব করতে না চাওয়া রাজ্য সরকারের বক্তব্য ছিল, সবরকম কোভিড বিধি বজায় রেখে যদি মেলা চালু রাখা যায় তবে অসুবিধা কিসের?
এ ব্যাপারে বিরোধী এবং বিজেপি নেতাদের প্রশ্নের জবাবে শাসক দল বলেছিল, যদি ভিড়ই তাঁদের উদ্বেগের আসল কারণ হয়ে থাকে তবে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের মতো বিজেপি-শাসিত পড়শি রাজ্যগুলি থেকে রাজ্যে পুণ্যার্থী পাঠানোর ব্যাপারে কেন তাঁরা প্রতিবাদ করছেন না। ওই রাজ্যগুলির সরকারকে কেন সতর্ক করছেন না? তখন কেন গাড়ি বোঝাই করে ভিনরাজ্য থেকে পুণ্যার্থীদের আসতে দেওয়া হচ্ছে?
তবে মেলা নিয়ে টানাপড়েন শুধু শাসক আর বিরোধীদের বাক্য বিনিময়েই আটকে থাকেনি। একদিকে যখন বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস নেতারা মেলা বন্ধের পক্ষে কথা বলছিলেন, তখন খোদ শাসকদলেরই অন্দরে তৃণমূলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা অভিষেক বন্দ্যাপাধ্যায়ের একটি বক্তব্যে নতুন মোড় নেয় গঙ্গাসাগর বিতর্ক।
অভিষেক বলেছিলেন, করোনার সাম্প্র্রতিক স্ফীতিকে নজরে রেখে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন সবরকম জনসমাগম বন্ধ রাখাই এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ। অভিষেকের এই বক্তব্য চিকিৎসক মহলের একাংশের সমর্থনও পায়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমার অধীন গঙ্গাসাগর। অভিষেক দক্ষিণ ২৪ পরগনারই ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ। মমতা যখন গঙ্গাসাগর মেলার পক্ষে কথা বলছেন, তখন অভিষেকের এই বক্তব্যে দলের মধ্যেই শুরু হয় বিতর্ক। অভিষেক দলের ‘বিরুদ্ধাচরণ’ করে শৃঙ্খলাভঙ্গ করেছেন কি না সেই প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ।
অন্যদিকে মেলা বন্ধের আর্জি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া সমাজকর্মী এবং চিকিৎসক প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেওয়া হয় কোভিড বিধি বজায় রেখে যাতে মেলা চালু রাখা যায় সে ব্যাপারে নজরদারি করবে বিশেষ কমিটি। প্রথমে সেই কমিটিতে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা শুভেন্দুকে রাখা হলেও পরে সেখান থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। তৈরি হয় দুই সদস্যের নজরদারি কমিটি। তবে সেই কমিটিতে কোনও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসক না থাকায় বিতর্কের মুখে পড়ে আদালতের সিদ্ধান্ত।
আদালত অবশ্য জানিয়েছিল, চাইলে এই কমিটি মেলা বন্ধ করতেও পারে। তবে শেষপর্যন্ত মেলা বন্ধ হয়নি। মেলার প্রস্তুতি এবং কোভিড বিধি যথাযথ পালনের ব্যবস্থা করে প্রশাসন। ভিড় এড়াতে ব্যবস্থা করা হয় ই-স্নানের। যেখানে আলাদা আলাদা গণ্ডিতে দাঁড়িয়ে ড্রোনের ছেটানো জলে স্নান করতে পারবেন পুণ্যার্থীরা।
আবার দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘটের জলে মকরস্নানের ব্যবস্থাও রাখা হয়। ঠিক হয় ৫০ জনের বেশি একসঙ্গে ঢুকতে দেওয়া হবে না কপিল মুনির আশ্রমে। মেলায় কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজে গিয়ে দেখে আসেন কোভিড নিরাপত্তার যাবতীয় বন্দোবস্ত।
শুক্রবার সকালেও মকরস্নানে বেশি ভিড় চোখে পড়েনি। কোভিড বিধি মেনে ই-স্নানেও অংশ নিতে দেখা যায় পুণ্যার্থীদের। কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখাও হয়নি। কম ভিড হলেও সাগরে ডুব দিয়ে স্নান করতে দেখা যায় অনেককেই। প্রশ্ন করা হলে তাঁদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘‘নোনা জলে করোনা হয় না।’’
তবে পুণ্যার্থীদের অনেককেই দেখা গিয়েছে কোভিড বিধি মেনে মকরস্নানে অংশ নিতে। যদিও পর্যবেক্ষকরা বলছেন গঙ্গাসাগর বিতর্ক হয়ত এখনই থামবে না। মকর সংক্রান্তির পর কী হয় এখন সেদিকেই নজর রাজনীতির কারবারি থেকে শুরু করে সাধারণ জনতার।