আশঙ্কা মতোই দীপাবলির সন্ধ্যার পর থেকে বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ৯টা থেকে রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে ওপার বাংলায় অতিক্রম করেছে ঘূর্ণিঝড়। সে দেশের সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’ সূত্রে জানা গিয়েছে, ঝড়ের তাণ্ডবে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা গিয়েছে, মৃত ৯ জনের মধ্যে কুমিল্লায় ৩ জন, ভোলায় ২ জন, সিরাজগঞ্জে ২ জন, নড়াইল ও বরগুনায় ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতির কারণে মঙ্গলবার খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া দফতরকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলো জানিয়েছে, সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ঝড়ের বেগ সবচেয়ে বেশি ছিল। হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টায় ৭৪ কিমি।
বরিশাল ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় নদীতে ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হয়। সিত্রাঙের তাণ্ডবে বাংলাদেশে ঠিক কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জানা হয়নি।
কিন্তু সিত্রাং-ই প্রথম নয়। এর আগেও বাংলাদেশের বুকে আঘাত হেনেছে একাধিক ঘূর্ণিঝড়। সাইক্লোনের তাণ্ডবলীলায় পদ্মাপারে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে প্রচুর ফসলের।
২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সে দেশে বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় দাপট দেখিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ঘূর্ণিঝড় ফণী, বুলবুল, আমপান, ইয়াস। আবার অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ঝড় জাওয়াদেরও প্রভাব পড়েছিল পদ্মাপারে।
২০১৯ সালে হানা দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় ফণী। অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থায় বাংলাদেশে ঢুকেছিল এই ঝড়। তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭০ কিমি।
ঝড়ের বেগ কম থাকলেও ফণীর প্রভাবে বাংলাদেশে প্রচুর ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। প্রথম আলো সূত্রে খবর, এই ঘূর্ণিঝড়ের হানায় সে বার ১ হাজার ৮০৪ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছিল।
ফণীর প্রভাবে ২ হাজার ৩৬৩টি বাড়ি সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ১৮ হাজার ৬৭০টি বাড়ি। ৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল।
ফণীর দাপটে ভোলা, নোয়াখালি ও লক্ষ্মীপুরে ১ জন ও বরগুনায় ২ জন-সহ মোট ৫ জনের মৃত্যু হয়। নিখোঁজ হয় শতাধিক গবাদি পশু।
প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপ আকারে অবস্থান করেছিল ফণী। এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, গত ৫২ বছরে সে দেশে যতগুলি ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়েছে, তার মধ্যে ফণীর স্থায়িত্বই সবচেয়ে বেশি ছিল।
ফণীর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হেনেছিল আরও একটি ঘূর্ণিঝড়। যার নাম দেওয়া হয়েছিল বুলবুল।
বুলবুলের তাণ্ডবে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, নোয়াখালি, বরিশাল, চট্টগ্রাম-সহ একাধিক এলাকার প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বুলবুলের দাপটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি যে যে জেলায় হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল সাতক্ষীরা। প্রায় ৪৭ কোটি টাকার মাছ নষ্ট হয়েছিল বাংলাদেশে।
এই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে প্রায় ১৭ হাজার কাঁচা বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছিল। আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় ৩৫ হাজার বাড়ি।
এর পর করোনা অতিমারির সময় হানা দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আমপান। যার তাণ্ডবে তছনছ হয়েছিল ও পার বাংলা। প্রথম আলো জানিয়েছে, সে দেশের ২৬টি জেলার মোট ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছিল।
২০২০ সালের মে মাসের এই ঘূর্ণিঝড়ে সে দেশের ছয় জেলায় মোট ২১ জনের মৃত্যু হয়। ১ লক্ষ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফণীর রেকর্ড ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রায় ২৮ ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালিয়েছিল আমপান।
আমপানের ভয়াল স্মৃতির পর ২০২১ সালের মে মাসে আরও একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। যার নাম ইয়াস। এর প্রভাবেও পদ্মাপারে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
আমপানের দাপটে সে দেশের ১ লক্ষ ২০ হাজার ৭১২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রায় ৮ হাজার ৬২ হেক্টর শস্যক্ষেতের ক্ষতি হয়। এ ছাড়াও মৎস্যচাষেও ক্ষতির মুখে পড়েন অনেকে। ক্ষতি হয় নদীবাঁধেরও।
প্রথম আলো সূত্রে খবর, সে দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ইয়াসের তাণ্ডবে মোট ২ হাজার ৯৫১ কোটি ৭০ লক্ষ ৩০ হাজার ৫২৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল।
ওই বছরের ডিসেম্বরে আরও একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। যার নাম জাওয়াদ। যার প্রভাবে বরিশাল, চাঁদপুর, ফরিদপুর ও মানিকগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। সরষে, মুসুর ডাল, ধান, তরমুজ, আলু চাষের ক্ষতি হয়েছিল।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার একটি ঘূর্ণিঝড় হানা দিল বাংলাদেশে। যার দাপটে প্রাণহানিও হয়েছে। সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে শেষমেশ সে দেশে ক্ষয়ক্ষতির অঙ্ক কী দাঁড়ায়, সে দিকেই তাকিয়ে পদ্মাপারের বাসিন্দারা। (সমস্ত ছবি রয়াটার্স থেকে)