ইনিও এক চা বিক্রেতার সন্তান যিনি বিখ্যাত হয়েছেন।
মাঝপথে পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছিল। তবু সেখান থেকেই সফল হয়েছেন। স্বক্ষেত্রে শীর্ষে উত্তরণও হয়েছে।
এক রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে অনেকে মিল খুঁজে পেতে পারেন। তবে ইনি রাজনীতির সঙ্গে কোনওভাবেই যুক্ত নন।
নাম ধর্মেশ ইয়েলান্দে। পেশায় নর্তক, নৃত্যপরিকল্পক এবং অভিনেতা। বলিউডের অনেক নায়ক-নায়িকার ‘ধর্মেশ স্যার’।
বলিউডের গানের দৃশ্যের নেপথ্য নাচিয়েদের একজন হয়ে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। আর এখন ইতিমধ্যেই পাঁচটি সিনেমায় মূলচরিত্রে অভিনয় করে ফেলেছেন ধর্মেশ। একটি ছবিতে আবার তাঁর সহ-অভিনেতা ছিলেন বরুণ ধবন এবং শ্রদ্ধা কপূর।
বলিউড পরিচালক ফারহা খান প্রথম জীবনে নৃত্যপরিকল্পক ছিলেন। সেখান থেকেই আসেন সিনেমার নির্দেশনায়। ধর্মেশকে নৃত্যপরিকল্পক হিসেবে কাজের সুযোগ দেন ফারহাই।
তার পর থেকে বিভিন্ন নাচের রিয়্যালিটি শোয়ের নৃত্যগুরু হিসেবে কাজ করেছেন ধর্মেশ। যদিও এখন তাঁর ডাক পড়ে বিশেষজ্ঞ বিচারক হিসেবে। বলিউডের প্রথম সারির তারকা, নৃত্যপরিকল্পকদের সঙ্গে পাশাপাশি এক মঞ্চে বসেন ধর্মেশ।
তবে এই জায়গায় পৌঁছতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। মাঝপথে পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছে। বাবার চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়েছে। এক সময় পিওনের চাকরিও করেছেন ধর্মেশ।
দেশের লাখ লাখ দরিদ্র পরিবারের মতোই ধর্মেশের ছোটবেলা কেটেছে অর্থকষ্টে। বাবার স্থায়ী চায়ের দোকান ছিল। কিন্তু সেই দোকানও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় স্থানীয় পুরসভা। বাধ্য হয়েই চায়ের একটি অস্থায়ী স্টল খোলেন ধর্মেশের বাবা। সেই দোকান থেকে দিনে ৫০-৬০ টাকা আয় হত। সেখানেই বাবাকে সাহায্য করতেন ধর্মেশ।
পরিবারে চার জন্য সদস্য। ওই টাকায় তাঁদের দৈনিক খরচ চালানো কষ্টসাধ্য। তবু তিলে তিলে পয়সা জমিয়ে সন্তানদের পড়ার খরচ চালাতেন ধর্মেশের বাবা। বলতেন, যা-ই হোক ‘‘পড়হাই কভি নেহি ছোড়নি চাহিয়ে।’’ শিক্ষায় যেন কোনও বাধা না আসে।
ধর্মেশ ছোট থেকেই নাচের ভক্ত। টিভির সামনে বসে বলিউড অভিনেতা গোবিন্দার নাচ দেখতেন। তাঁকে নকল করে নাচতেন রাস্তায় নেমে। ছোট্ট বাড়ির অল্প পরিসরে হাত-পা ছুড়ে নাচার জায়গা ছিল না।
ধর্মেশ যখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র, তখন একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। জিতেও যান। ছেলের নাচে আগ্রহ দেখে অভাবী সংসারেও ধর্মেশকে নাচের ক্লাসে ভর্তি করান বাবা।
তবে নাচতে গিয়ে পড়াশোনার ক্ষতি করে ফেলেন। ধর্মেশ যখন ১৯। কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তখন পরীক্ষায় নম্বর খারাপ হওয়ায় পড়াশোনা ছেড়ে দেন। বদলে পিওনের কাজ করতে শুরু করেন।
ওই সময়েই ছোটদের নাচ শেখাতেও শুরু করেন ধর্মেশ। তখন তাঁর আয় মাসে ১ হাজার ৬০০ টাকা। তবে ওই টাকা সংসারে দিয়ে নিজের খরচ চালাতে পারছিলেন না। ধর্মেশ ঠিক করেন নাচকেই পেশা করবেন। পিওনের কাজ ছেড়ে বিভিন্ন ছবির সেট নেপথ্য নাচিয়েদের দলে কাজ করতে শুরু করেন তখন থেকেই।
তবে কপাল ফেরে নাচের একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পর। টেলিভিশন সম্প্রচারিত এই নাচের প্রতিযোগিতা জেতেন ধর্মেশ। পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে বাবার ঋণ শোধ করেন।
সিনেমায় অভিনয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ধর্মেশ। বাড়ি ছেড়ে মুম্বইয়ে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু দু’বছরে কোনও সুযোগ আসে না। মাঝখান থেকে টাকাও শেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই বাড়ি ফিরে আসেন।
মাস খানেক পর পরিস্থিতি বদলায়। ‘ডান্স ইন্ডিয়া ডান্স’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান ধর্মেশ। প্রতিযোগিতায় না জিতলেও তাঁর নৃত্য পরিকল্পনা নজরে পড়ে। সিনেমায় নৃত্য পরিকল্পক হিসেবে কাজের সুযোগ আসতে শুরু করে। বিভিন্ন নাচের রিয়্যালিটি শোয়েও অতিথি হিসেবে হাজির থাকার প্রস্তাব আসতে থাকে।
তবে সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয়ের স্বপ্নপূরণ হয় আরও কয়ক বছর পর। ‘এবিসিডি’ বা ‘এনিবডি ক্যান ডান্স’ ছবিতে তাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন রেমো ডিসুজা। ছবিটি বক্সঅফিসে দারুণ সফল হয়। ওই ছবি থেকে পাওয়া টাকায় পরিবারের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে একটি বাড়ি কেনেন ধর্মেশ।
এখন তিনি ৩৮।নাচের রিয়্যালিটি শো ‘ডান্স দিওয়ানে’র অন্যতম বিচারক। ইতিমধ্যেই পাঁচটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। অর্থাভাবও আর নেই। ৩৭ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক ধর্মেশ। বার্ষিক আয় ৩ কোটি টাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরনো চায়ের ব্যবসা এখনও ছাড়েননি ধর্মেশের বাবা।
ধর্মেশ জানিয়েছেন, বাবাকে অনেকবার কাজ বন্ধ করতে বলেছেন তিনি। কিন্তু তিনি রাজি হননি। আসলে শিকড়কে ভুলে যেতে চাননি।
এখন গোটা দেশ ধর্মেশকে এক ডাকে চেনে। তবে ধর্মেশ জানিয়েছেন সাফল্য তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। বাবাকে দেখেই মাটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার শিক্ষা পেয়েছেন। জীবনে যত বড়ই হন, এই শিক্ষা কোনও দিন ভুলবেন না তিনি।