পিঙ্কি হরিয়ান। শৈশবে বাবা-মার সঙ্গে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা চাইতেন এই তরুণী। হন্যে হয়ে খাবারের সন্ধান করতেন ম্যাকলিয়ডগঞ্জর বিভিন্ন আবর্জনার স্তূপে। ২০ বছর পর সেই পিঙ্কিই এখন চিকিৎসক। চিন থেকে ডাক্তারি পাশ করেছেন তিনি। ভারতেও যাতে খুব শীঘ্রই ডাক্তারি শুরু করতে পারেন, তার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করে চলেছেন। কিন্তু কী ভাবে রাস্তায় সেই ভিক্ষুক হয়ে উঠলেন এক জন চিকিৎসক?
গল্পের শুরু ২০০৪ সালে। পিঙ্কিকে ভিক্ষা করতে দেখেন তিব্বতি উদ্বাস্তু সন্ন্যাসী তথা ধর্মশালার একটি দাতব্য ট্রাস্টের ডিরেক্টর লোবসাং জাময়াং। পিঙ্কিকে দেখে মায়া হয় তাঁর।
এর কয়েক দিন পরেই পিঙ্কির সঙ্গে আবার দেখা হয় লোবসাঙের। পিঙ্কিরা যে বস্তিতে থাকতেন সেখানে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন লোবসাং। খুদে পিঙ্কিকে দেখে চিনতে পারেন বৌদ্ধ ভিক্ষু।
পিঙ্কি এবং তাঁর বাবা-মার সঙ্গে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলেন লোবসাং। তাঁদের দুর্দশার কথা শোনেন। পিঙ্কির বাবা কাশ্মীরি লালকে তিনি বোঝান, মেয়েকে যেন তিনি উপযুক্ত শিক্ষা দেন। মেয়েদের জন্য শিক্ষা কেন প্রয়োজন তা-ও বুঝিয়ে বলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বোঝানোর পর রাজি হন লাল।
২০০৪ সালে ধর্মশালার দয়ানন্দ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করানো হয় পিঙ্কিকে। পড়াশোনার পাশাপাশি হতদরিদ্র শিশুদের জন্য দাতব্য ট্রাস্টের তৈরি একটি হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয় তাঁর।
ওই ট্রাস্টের সভাপতি তথা লোবসাঙের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অজয় শ্রীবাস্তব জানান, প্রথম দিকে বাড়ির কথা ভেবে মনখারাপ করত পিঙ্কি। কিন্তু পড়াশোনায় মনোযোগ ছিল। কারণ কম বয়সেই সে বুঝতে পেরেছিল যে, দারিদ্র থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় শিক্ষা।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ডাক্তারির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট পাশ করেন পিঙ্কি। কিন্তু র্যাঙ্কের কারণে বেসরকারি কলেজে সুযোগ পান। বেসরকারি কলেজে পড়াশোনার আর্থিক সামর্থ্য তাঁর ছিল না।
ব্রিটেনের একটি দাতব্য ট্রাস্টের সহায়তায় ২০১৮ সালে চিনের একটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন পিঙ্কি। সম্প্রতি ডাক্তারির পড়া শেষ করে তিনি ধর্মশালায় ফিরেছেন।
২০ বছরের অপেক্ষার পর চিকিৎসক হতে পেরে খুশি পিঙ্কি। এখন তিনি নিঃস্বদের সেবা করতে চান বলেই জানিয়েছেন।
সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে পিঙ্কি বলেন, ‘‘শৈশব থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বড় হতে হয়েছে। পরিবারকে দুর্দশায় দেখেও কিছু করার ক্ষমতা ছিল না আমার। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনে সফল হওয়ার জেদ চাপে।’’
পিঙ্কি আরও বলেন, ‘‘ছোটবেলায় আমি একটা বস্তিতে থাকতাম। আমাকে আমার পরিবারের দুঃখ দূর করতে হবে— এটাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রেরণা।’’
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে পিঙ্কি জানিয়েছেন, চার বছর বয়সে যখন তাঁকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন।
পিঙ্কি বলেন, ‘‘সেই সময়ে আমি জানতাম না যে এক জন চিকিৎসকের কী কাজ। কিন্তু আমি সবসময় মানুষকে সাহায্য করতে চাইতাম।’’
পিঙ্কি চিন থেকে ডাক্তারি পাশ করায় ভারতে চেম্বার খোলা বা রোগী দেখার অনুমতি তাঁর নেই। তাই বর্তমানে ‘ফরেন মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট এগজামিনেশন (এফএমজিই)-এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ওই পরীক্ষায় পাশ করলেই ভারতে ডাক্তারি করতে পারবেন পিঙ্কি।
পিঙ্কি জানিয়েছেন, নিজের ভাই এবং বোনকেও তিনি স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। তবে তাঁর সাফল্যের সমস্ত কৃতিত্ব বৌদ্ধ ভিক্ষু লোবসাংকেই দিয়েছেন।
পিঙ্কির কথায়, ‘‘ওঁর (লোবসাং) জন্যই নিঃস্ব এবং দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করার ভাবনা এসেছে। আমি স্কুলে থাকাকালীন তিনিই আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলেন। আমার প্রতি ওঁর বিশ্বাসের কারণেই আমি ভাল করে পড়াশোনা করতে পেরেছি।’’
অন্য দিকে লোবসাং জানিয়েছেন যে, নিঃস্ব শিশুদের শিক্ষার জন্যই ট্রাস্ট তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি বুঝতে পারিনি যে এই শিশুদের মধ্যে এত প্রতিভা রযেছে। ওরা আদর্শ হয়ে উঠেছে এবং অন্যদের অনুপ্রাণিত করছে।’’